Header Ads

বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের কাছে কিংবদন্তি অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী ছিলেন 'ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র'



সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রসঙ্গে বলেছিলেন "তিনি যদি আমেরিকাতে জন্মাতেন তাহলে অস্কার পেতেন"। 'পথের পাঁচালী' ছবির অন্যতম অভিনেতা তিনি। যার অভিনয় সূচনা করেছিল বাংলা চলচ্চিত্রে স্বর্ণযুগের। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী। মহানায়ক উত্তমকুমারও মুগ্ধ হতেন তাঁর সাবলীল অভিনয়ে। প্রায় ৩১৬ টি বাংলা ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনয় জগতে অনন্য অবদান দেখিয়েছিলেন তিনি। যথেষ্ট প্রতিভাবান অভিনেতা হওয়া সত্বেও তাঁর দর ছিল স্বল্প। তবুও তিনি কখনও ভেঙ্গে পড়তেন না। অভিনয়ের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা। যার কাছে টাকা ছিল অতি তুচ্ছ ব্যাপার। তিনি অভিনয় করতেন নাম-যশ-খ্যাতির জন্য। কেবল অর্থের জন্য তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন না। 


উত্তম কুমারের সুপারিশে তাঁকে বেশি টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হলেও তিনি অস্বীকার করতেন অতিরিক্ত পারিশ্রমিক নিতে। তিনি ছিলেন ভদ্র, নম্র ও অত্যন্ত সৎ। তিনি সততার সাথে কাজ করতে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনশোর ওপর ছবি করলেও দারিদ্র্যতা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। শোনা যায় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'পরশপাথর' ছবিতে তিনি ১৫০০ টাকা পারিশ্রমিকে কাজ করেছিলেন। এমনকি বেশ কিছু ছবিতে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতেও দ্বিধা বোধ করতেন না তিনি। ট্রামে করে শ্যুটিং স্পটে যাতায়াত করতেন তিনি। শিল্পের জন্য দারিদ্র্যতার কথা একবারও চিন্তা করতেন না তিনি।

সত্যজিৎ রায় যখন তাঁকে 'পরশপাথর' ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন তখন এই প্রস্তাবটি শুনে তিনি হাউহাউ করে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। এই ছবিতে অভিনয় করে তিনি জীবনে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন। হাস্যকৌতুক চরিত্রে বেশিরভাগে ছবিতে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে৷ বাংলার প্রথম সারির হাস্যকৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র বিশেষ৷ এমন অভিনেতার সাথে সচরাচর কারো তুলনাও চলেনা। টাক মাথা, গলায় পৈতে, আটপৌরে ধূতি ও পাঞ্জাবী পরিহিত তাঁর মোটা গড়ন চেহারা প্রতিটি ছবিতেই বিদ্যমান ছিল৷   

কিংবদন্তি অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী জীবনে কোনোদিনই স্বাচ্ছন্দের মুখ দেখেননি। কখনো চেষ্টা পর্যন্ত করেননি। তিনি পারতেন আভিজাত্য জীবনকে বেছে নিতে কিন্তু অভিনয় যেভাবে তাঁর আপাদমস্তক ধারণ করেছিল তাতে অভিনয়ের কথা ভেবে ভুলে যেতেন আভিজাত্যের কথা। বিখ্যাত হাস্যকৌতুক অভিনেতা হিসেবে তাঁর নাম উঠে এলেও হাস্যকৌতুকতার বাইরে গিয়েও অন্যান্য চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। 'পথের পাঁচালী' ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন প্রসন্ন পন্ডিতের চরিত্রে, 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবিতে মেসমালিক রজনীবাবু ও 'পরশপাথর' ছবিতে পরেশচন্দ্র দত্তের চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। প্রতিটি চরিত্রে তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত। 

তিনি নিঃসন্তান হওয়ার জন্য সৌমিত্র চ্যাটার্জির মতো অভিনেতাদের নিজের সন্তান বলে মনে করতেন। সত্যজিৎ রায়ের কাছে তিনি ছিলেন 'ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র'। 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবিতে উত্তম-সূচিত্রা জুটিকে তিনি অভিনয়ে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। মেসমালিক রজনীবাবু চরিত্রটি দর্শকদের মনে গেঁথে গিয়েছিল। শেষ জীবনটি তাঁর কেটেছিল দারিদ্র্যতার সাথে। মৃত্যুর আগে হঠাৎ করে যেদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন সেদিন তাঁর কেউ খোঁজ নিতে আসেননি। মৃত্যুর পর অনেক বাঙালি ভুলে গেছেন অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর কথা। তিনি আজ যেন মেঘে ঢাকা তারায় পরিণত হয়েছেন। যারা না থাকলে বাংলা চলচ্চিত্র স্বর্ণযুগের মুখ দেখত না তাদের মধ্যে অন্যতম মুখ ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী।    
       
তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ের প্রসঙ্গে সত্যজিৎ নায়ক সৌমিত্র চ্যাটার্জি বলেন যে "তাঁর অভিনয়ের মধ্যে কোনো বিদেশি অভিনেতার প্রভাব লক্ষ্য করা যেতনা। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ দেশীয় অভিনেতা। দেশের মানুষের চরিত্র লক্ষণের মধ্যেই তাঁর শেকড় খুঁজতে হয়।" 

অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর শেষ জীবন অত্যন্ত দুঃখের মধ্যে কেটেছিল। চিকিৎসার একটা টাকাও ছিলনা তাঁর। স্ত্রী ঊষারানি দেবী একমুঠো খাবার সংগ্রহের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর সরকারি তরফে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কোনো বন্দোবস্ত করা হয়নি। একজন মানুষ যার কাছে অভিনয় ছিল ধ্যান-জ্ঞান তাঁকে মৃত্যুর পর অবজ্ঞা করা হয়েছিল৷ বর্তমান প্রজন্মের হয়তো বেশিরভাগ মানুষই তাঁর নাম জানেন না। আমরা বাঙালিরা এতোটাই অসচেতন যে তাঁকে সঠিক শ্রদ্ধা দিতে পারিনি। 

No comments