Header Ads

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র


     
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র। যিনি কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের বেশ কিছু ছবিতে। তাঁর মতো সিনেমাটোগ্রাফার ভারতে খুবই দুর্লভ। তাঁর হাতে ছিলে অনন্য শিল্পের ছোঁয়া। ছবির প্রতিটি দৃশ্য নির্ধারণ অত্যন্ত যত্ন সহকারে ক্যামেরাতে বন্দী করতেন। এক একটা দৃশ্য নিখুঁত ভাবে তৈরি করতেন। শোনা যায় চায়ের লিকারের রঙ পরিবর্তনের জন্যও তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতেন। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি করার সময় তিনি যথেষ্ট ধৈর্য্যের সঙ্গে কাজ করতেন। 



চারুলতা বা পথের পাঁচালী ছবিতে আমরা যে সাজসজ্জা দেখতে পাই। তাতে গভীর শিল্পসত্ত্বার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সর্বদা একটি বাড়ির সেট বানালে লক্ষ্য রাখতেন বাড়ির আসবাবপত্র ঠিক জায়গায় বসানো হয়েছে কিনা। জানালার অবস্থান ঠিক জায়গায় আছে কিনা। বাড়ির সৌন্দর্য কতটা দর্শকদের মুগ্ধ করবে ইত্যাদি বিষয়গুলোতে তিনি জোর দিতেন। যে কারণে সত্যজিৎ রায়দের মতো স্বনামধন্য পরিচালকদের কাছে তিনি বেশ প্রিয় ছিলেন। তাঁর মধ্যে শিল্পের সবকিছুই বিদ্যমান ছিল। 

সাজসজ্জার প্রসঙ্গে তিনি চারুলতা ছবির প্রসঙ্গে একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে মেয়েদের সেট নিয়ে অন্দরসজ্জা ও আতিশয্য ঠিকঠাক বানানো বেশ জটিল ছিল। আর মেয়েদের সাজসজ্জাগুলো ভালোভাবে বানাতে পারলে নারীদের তা বেশ মনে ধরতো। চারুলতা ছবিতে যেভাবে নারীদের জীবনযাপন, অন্দরসজ্জা ও সাজসজ্জাকে যত্নের সহিত বানানো হয়েছিল। চারুলতা ছবি দেখে তাঁর মা বেশ আনন্দ উপভোগ করেছিলেন। চারুলতা ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফির কাজ করবার জন্য তিনি তাঁর মায়ের কাছে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন ৷    

একবার বিখ্যাত ফরাসী পরিচালক জঁ রনোয়ার তাঁর ছবি দ্য রিভারের শ্যুটিং এর জন্য কলকাতায় আসেন৷ তিনি এই ছবিতে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন৷ তবে কাজ পাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে তাঁর বাবার সহায়তায় তিনি শ্যুটিং দেখার সুযোগ পান। তিনি এ ছবির শ্যুটিং কালে শ্যুটিং এর বিশদ বিবরণ লিখে রাখতেন ও ছবি আঁকতেন। যার মধ্যে লাইট, ক্যামেরা ও অভিনেতাদের নড়াচড়া সবকিছুর সঠিক বিবরণ পাওয়া যায়। দ্য রিভার ছবির চিত্রগ্রাহক ক্লদ রনোয়ার শ্যুটিং এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য তাঁর বিবরণটি দেখেন। তিনি এ ছবিতে কাজ করার সান্নিধ্যে পরিচিত হন সত্যজিৎ রায়ের সাথে।   
  
মাত্র বাইশ বছর বয়সে তাঁর হাতে খড়ি হয় সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী ছবিতে তিনি সিনেমাটোগ্রাফির সুযোগ পান৷ এই একটা ছবিতেই কাজ করে বদলে যায় তাঁর জীবনযাত্রা। সমগ্র বাঙালি সমাজের কাছে সমাদৃত হয় এ ছবি। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে তিনি সুনাম কুড়োলেন। এরপর একটানা কাজ করে গেলেন সত্যজিৎ রায়ের পরবর্তী নয়টি ছবিতে। পথের পাঁচালীর পর সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় মুক্তি পায় অপরাজিত, পরশপাথর, জলসাঘর, অপুর সংসার, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মহানগর, চারুলতা ও নায়ক। এই সবকটা ছবিতেই তিনি সিনেমাটোগ্রাফির কাজ করেছেন। কেবল বাংলাতেই নয় তিনি পাঁচটি হলিউড, একটি চাইনিজ ও দুটো হিন্দি ছবিতেও সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন। জেমস ইভোরি পরিচালিত দ্য হাউজ হোল্ডার, শেক্সপিয়ার ওয়াল্লাহ, দ্য গুরু ও বম্বে টকিজ, ইসমাইল মার্চেন্ট পরিচালিত মহাত্মা অ্যান্ড দ্য ম্যাড বয়, তাং সু সুয়েন পরিচালিত দ্য আর্চ, বাসু চ্যাটার্জি পরিচালিত তিসরি কসম ও রমেশ শর্মা পরিচালিত নিউ দিল্লি টাইমস প্রভৃতি ছবিতে তিনি সিনেমাটোগ্রাফির কাজ করেছেন।

উপমহাদেশের ছবিতে তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন "বাউন্স লাইটিং"। তিনি বিশ্বমানের ছবির ধরণ ব্যবহার করতেন তাঁর নিজস্ব সিনেমাটোগ্রাফিতে ৷ তাঁর হাতের জাদুতে বাংলা চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল৷ তিনি সিনেমাটোগ্রাফির জন্য অর্জন করেছেন জাতীয় পুরস্কার ও পদ্মশ্রী পুরস্কার। তিনি লাইফটাইম স্বীকৃতি হিসেবে কোডাক পুরস্কার লাভ করেন। তিনি শেষজীবনে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের সিনেমাটোগ্রাফির অধ্যাপক ছিলেন।

No comments