Header Ads

পরাধীন ভারতবর্ষের কয়েকজন বঙ্গসন্তানের কলকাতা থেকে সাইকেলে কাশ্মীর অভিযানের কাহিনী || পর্ব এক


বিশ্বজয় বাঙালির রক্তে। বাংলার ঘরে বারে বারে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য অভিযাত্রী। যারা নতুন পৃথিবী আবিষ্কারের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন চাঁদের পাহাড় থেকে বালুময় সাহারায়। আমাদের জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে পুরো পৃথিবী ভ্রমণের সৌভাগ্য সবার হয়না। তাই অভিযাত্রীরা যতটুকু পেরেছেন তাই দিয়ে সৃষ্টি করেছে নিজেকে। পরাজয় পায়ের ভৃত্য করে তারা সামিল হয়েছেন অভিযানে। 


বাংলার দামাল ছেলেমেয়েরা কখনো জয় করেছে পাহাড়-পর্বত, কখনো সাঁতরে পার হয়েছে ইংলিশ চ্যানেল, কখনো আবার সাইকেলে চড়ে বিশ্বরেকর্ড করেছে। এই সাইকেল নিয়েই যখন কথা উঠলো তখন বাংলার রাজধানী কলকাতার সাইকেল সমাজের অস্তিত্ব নিয়ে একটা ঘটনার কথা তুলে ধরা যাক। 

সালটা ১৯৩৩। কলকাতার আঠারো বি ব্রজলাল দত্ত লেনে অবস্থিত 'স্পীডি স্টারস্' নামে একটি সংঘের কয়েকজন রসবেত্তা তরুণ বঙ্গসন্তানেরা কলকাতা থেকে কাশ্মীর যান। বিশ্বজয়ের নেশা তাদের আপাদমস্তক ধারণ করেছিল। এ দলের অধিনায়ক ছিলেন অতুল্যকুমার বন্দোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন সেই সময়কার সাপ্তাহিক সাময়িকী 'রিক্তা' পত্রিকার সম্পাদক। তার দলে সদস্য ছিলেন মোট চারজন। তাঁরা হলেন নীরেন ঘোষ, শিশির বসু, রমণী মিত্র ও কৃষ্ণ দাস। 

১৯৩৩ সালের ১২ ই মার্চ সংঘের সহয়তায় তাদের অভিযানের সকল বন্দোবস্ত হয়। ঐ তারিখেই সংঘ থেকে তাঁদের অভিযানে যাওয়ার জন্য বিদায় জানানো হয়। তাঁরা বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছেন গন্তব্যের দিকে। কাশ্মীর বসে রয়েছে এঁদের অপেক্ষায়। অনেক রাত, অনেক দিন লেগে যাবে কাশ্মীরে পৌঁছতে। তাঁরা দূর্দান্ত সাহসের সাথে দ্বিচক্রযানের প্যাডেল পায়ের মাধ্যমে একটানা ঘুরিয়ে সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে অভিযানে ব্যস্ত। 

যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই তাঁরা অত্যন্ত সমাদৃত হচ্ছেন। কলকাতা পেরিয়ে তাঁরা প্রথম পর্যায়ে বর্ধমান, আসানসোল, গোবিন্দপুর, বোগাদর, শেরখালি, সাসারাম, মোগলসরাই, বারাণসী, এলাহাবাদ, ফতেপুর, কাশিপুর, মুসৌরী, কনৌজ, আগ্রা, মথুরা, বৃন্দাবন, দিল্লি, আম্বালা, লুধিয়ানা, ফিরোজপুর, লাহোর পর্যন্ত মোট বারোশো মাইল ভ্রমণ করেন। 

অভিযান চলাকালীন বর্ধমানের শ্রীযুক্ত বলাই দেববর্মা, আসানসোল নিবাসী ডাঃ এ.সি. লাহিড়ী, গোবিন্দপুর নিবাসী শ্রীযুক্ত নুরুল হোসেন, বোগাদর নিবাসী সন্তোষপ্রসাদ, বিহারের ডেইরি-অন-সোনের রামলাল সরকার, বারাণসীর জীবনকৃষ্ণ মিত্র, কাশীপুরের বাংলা ক্লাবের সম্পাদক সুধীর মিত্র, আগ্রার এ.কে বাগচি, মথুরা হোটেলের ম্যানেজার, বৃন্দাবনের রায়সাহেব এইচ.ডি.ঘোষ বিশেষভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন ৷   
                                                          
তাঁরা এভাবে অনেক জায়গায় সমাদৃত হলেও যাত্রাপথে তাঁদের মাঝেমধ্যে বেশ কিছু অসুবিধাতেও পড়তে হয়। কতগুলো জায়গায় আশ্রয়স্থলের অভাবের জন্য প্রচন্ড বেগ পোহাতে হয় তাঁদের৷ মথুরা থেকে দিল্লি প্রায় নব্বই মাইল পথ তাঁরা একটানা অতিক্রম করলেন শরীরের সমস্ত ক্লান্তি দূর করে। কাশ্মীর পৌঁছাতে আরো অনেক সময় অপেক্ষমান। তার আগে একটানা নব্বই মাইল পথ অতিক্রম করেই একটি বিশ্বরেকর্ড গড়ে ফেললেন তাঁরা। উত্তর ভারতে সেই সময় প্রচন্ড গরমের দাবদাহ। তাই তাঁরা ঠিক করলেন দিনের বেলাতে যতটা সম্ভব যেতে হবে দরকার পড়লে যদি রাস্তা ভালো থাকে তাহলে রাত্রিবেলায় তাঁদের সাইকেল চালাতে হবে। 

দিল্লি পৌঁছানোর পর তাঁদের গন্তব্যস্থল ঠিক হলো লাহোরে৷ সেখানে পৌঁছে তিনদিন পর আবারো বেরিয়ে পড়লেন অভিযানে। বাঙালি তরুণদের এমন প্রশংসনীয় চেষ্টায় মুগ্ধ হয় গোটা দেশ। পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে এমন অভিযান সেকেলে সচরাচর দেখা যায়নি। দেশের পরিস্থিতি যখন থমথমে। সংগ্রামীরা যখন ব্যস্ত মিটিং, মিছিল, পিকেটিং-এ। প্রতিদিন যখন প্রাণ ঝরছে কত শত বিপ্লবীর। এমন সময়ে তাঁরা ছুটে চলেছেন নতুন কিছু আবিষ্কারের সন্ধানে। বিপ্লবীরা যেমন লড়াই করছে দেশের জন্য, তাঁরাও তেমন দেশের নাম বিশ্বসভায় তুলে ধরতে সামিল এক ভয়ংকর অভিযানে।

No comments