Header Ads

কর্ণফুলী থেকে গঙ্গা। সাধারণ এক নারীর অসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনী



ফয়েজুন্নেসা বিবিকে চেনেন?

কি করে চিনবেননা ইনি কোন সিনেমার নায়িকা না কোন সেলিব্রেটি।চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর গন্ডগ্রাম ফতেয়াবাদের এক বিধবা।জালালাবাদ যুদ্ধে আহত অম্বিকা চক্রবর্তী পালিয়ে এনার আশ্রয়ে উঠেছিলেন।তাঁর মাথার দাম তখন পাঁচ হাজার টাকা।পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে জেনেও আগলে রেখেছিলেন তিনদিন।বিদায় নেবার সময় হতদরিদ্র সেই মহিলাকে কিছু টাকা দিতে গেলে বলেছিলেনএকটা সাহেব মেরে খবর দিও। আমার ধার শোধ হয়ে যাবে!



ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এমন কত সহস্র ফয়েজুন্নেসার অবদান রয়ে গেছে যা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি।

কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে ফিরে আসি কলকাতায়, গঙ্গা নদীর তীরে প্রাণবন্ত এক শহর।বিপ্লবের পীঠস্থান। ডেফ এ্যান্ড ডাম্বস্কুলের কাজ নিয়ে সেই কলকাতায় পৌঁছে গেলেন খুলনার এক যুবতী।দেশ জুড়ে তখন স্বদেশি উন্মাদনা, তার কেন্দ্রবিন্দুতে কলকাতা শহর।আলাপ হল কমলাদি, মানে কমলা দাশগুপ্তের সঙ্গে।তিনি আবার সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন যুগান্তর পার্টির রসিকলাল দাসের কাছে।দেশের ডাক এসেছে, মেয়েদেরও গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে।চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রীতিলতা বা কল্পনা না হয়েও স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক হওয়া যায়।যাহোক লড়াই শেষ, এবার বিপ্লবীদের আত্মগোপনের পালা।গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, মাখন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্তদের গোপন আশ্রয় চাই।ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে যদি সেই আশ্রয় মেলে সবদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।গোন্দলপাড়ার বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় নিলেন সেই দায়িত্ব।

চন্দননগরের দক্ষিণে তেমাথায় কাশীশ্বরী পাঠশালার জন্য একজন বিবাহিত শিক্ষয়িত্রী চাই।যদি ঐ মহিলা সেই পদে যোগ দিয়ে গোন্দলপাড়ায় থাকেন তাহলে সব সমস্যার সমাধান।কিন্তু উনি যে অবিবাহিত।শেষমেশ সেই সমস্যাও মিটলো।শশধর আচার্য নামে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলের এক কর্মচারী স্বামীর ভূমিকায় নিঃসংকোচে এসে উঠলেন গোন্দলপাড়ায় জনৈক দাশরথী ঘোষের বাড়িতে।স্বামী রেলের কাজে আর স্ত্রী স্কুলে পড়াতে বেরিয়ে যান।সারাদিন বাড়ি থাকে তালাবন্ধ।আত্মগোপনের এমন নিরাপদ জায়গা আর কোথায় পাওয়া যাবে?

১৯৩০-এর মে মাসে মোটরগাড়িতে চেপে ছদ্মবেশে এসেছিলেন অনন্ত সিংহ, আনন্দ গুপ্ত, মাখন ঘোষাল আর গণেশ ঘোষ।যুব বিদ্রোহের বীর সেনানীরা।জুন মাসে হঠাৎ কলকাতায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন অনন্ত সিংহ। এবার এলেন লোকনাথ বল।ফাঁকা বাড়িতে গণেশ ঘোষের নির্দেশে রিভলভারের কার্তুজ, বোমা তৈরি করেন তাঁরা।বিপ্লবের প্রস্তুতি চলে সংগোপনে।এদিকে তার জীবনে পরপর ঘটনার মিছিল।বাবা মারা গেলেন, সংসারের চরম দুরবস্থা।সবকথাই কানে আসে, কিন্তু নিরুপায় তিনি।চন্দননগরে তাঁর ভূমিকা যে নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে। আগে দেশ তারপর তো ব্যক্তিস্বার্থ।দিনগুলো সত্যিই বড় ভালো কাটছিল।দোতলায় ভেতর দিকের একটা ঘরে থাকতেন বিপ্লবীরা।তাঁরাই পালা করে রাতে পাহারা দিতেন বাড়ির ছাদে।তাইতো সেদিন আনন্দ গুপ্তের নজরে পড়েছিল পুলিসের হেলমেটের নড়াচড়া।

১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩০, রাত তখন তিনটে।মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে এলো পুলিসের বুটের আওয়াজ। চন্দননগর গোন্দলপাড়ার এক বাড়ির পাশে সারি সারি হেলমেট পরা মাথা।পুরো বাড়িটাকেই ঘিরে ফেলেছে তারা।স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি বিশেষ অধ্যায়ের সূচনা হলো সেদিন চন্দননগরে।

ওই বাড়িতে তখন লুকিয়ে রয়েছেন চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা আর তাদের তথাকথিত দাদা-বউদি।যুবকেরা পণ করেছেন তাঁরা আর পালাবেন না।পালাতে পালাতে তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।আজ তাঁরা মরিয়াহয় মারবেন নয় মরবেন।

বিপ্লবীরা কিন্তু আগেই খবর পেয়েছিলেন তাঁদের শেষ করতে আসছে ব্রিটিশ পুলিস।বিপ্লবী বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ভাই সত্যেনকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলেনকে এক কালীপদ ঘোষ বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিসকে তাদের ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে।পুলিস কমিশনার টেগার্ট স্বয়ং আসছেন।তাঁরা যেন চন্দননগর ছেড়ে পালিয়ে যান। ফরাসি আইনে রাতে কোনও বাড়ি খানা-তল্লাসী করার নিয়ম নেই।বাড়ি ঘিরে তাই সারারাত ওঁত পেতে বসে রইলো টেগার্ট আর তার বিশাল পুলিসবাহিনী।

আর সময় নেই।বিপ্লবী গণেশ ঘোষ বললেনপেছনের দরজা দিয়ে রিভলভারের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগোতে হবে।ওরা বার হতেই শুরু হল পুলিসের গুলিবৃষ্টি।টর্চের জোরালো আলোয় চারপাশ একদম দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।শেষরক্ষা হল না।মাখন ঘোষালের বুকেমাথায়শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগল গুলি।ছিটকে পুকুরের জলে পড়লেন তিনি।সবচেয়ে কমবয়সি আনন্দ গুপ্তের ঊরুতে গুলি লাগায় তিনি তখন মাটিতে ধরাশায়ী।শিগগিরই শেষ হলো এক অসম লড়াই।


শুরু হলো বন্দি বিপ্লবীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন।নারী হয়ে রেহাই পেলেন না ছদ্মবেশী বউদিও।পুলিসের লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে গর্জে উঠলেন তিনি, ‘তোমরা সভ্য জাত বলে গর্ব করএই তার পরিচয়?’ আনন্দ গুপ্তলোকনাথ বলগণেশ ঘোষমহিলা আর তাঁর ছদ্ম স্বামীর বেশধারী শশধর আচার্যকে বন্দি করে গাড়িতে তুলল তারা।ওদিকে পুকুরের জল থেকে মাখনলাল ঘোষালের মৃতদেহ উদ্ধার করে মেয়রের নেতৃত্বে মিছিল করল চন্দননগরবাসী।সেই স্বনামধন্য মেয়র হলেন চারুচন্দ্র রায়।যার নেতৃত্বে শহরবাসী ফরাসি পুলিসকে মৃতদেহ স্পর্শ করতে দেয়নি। চট্টগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত মাখনলালের নশ্বর দেহ ভস্মীভূত হল চন্দননগরের মহাশ্মশানে।

১৯৪৩ সালজেলে বসে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছিলেন মহিলা।২রা সেপ্টেম্বর ১৯৩০-এ প্রথম পুলিসের হাতে বন্দি হন।কুখ্যাত হিজলি জেলে ছ-ছটা বছর কাটল।তারপর বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সে’ গ্রেপ্তার হয়ে সিউড়ি জেলেকলকাতার বিভিন্ন জেলে কাটল অনেকগুলো দিন।অবশেষে ১৯৩৮ সালে এল সাময়িক মুক্তি। ১৯৪২-এ আবার কারাবাস।যদিও প্রায় বিনা দোষেই।এখনও অধরা সেই স্বপ্ন— দেশমাতৃকার স্বাধীনতা। মাঝেমাঝেই মনে পড়ে ভয়ঙ্কর সেই রাতটার কথা।১৯৩০-এর ১লা সেপ্টেম্বর....... সন্ধেবেলা রুটি সেঁকতে সেঁকতে বারবার মনে হচ্ছিল ভয়ানক কিছু ঘটবে আজই।ভাইদের জন্য হয়তো রুটি আর বানাতে হবে না। উনুনে ধিকিধিকি জ্বলছে আগুন।সেই আঁচের দিকে তাকিয়ে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন তিনি।

শেষ রুটিটা একদম পুড়ে গেল কখন বুঝতেই পারেননি।ওটাকে আড়াল করে রাখতে হবে।খাওয়ার সময় নিয়ে নেবেন একফাঁকে।দেখতে পেলেই ভাইরা চেঁচাবে।ওরা যে তাঁদের পুঁটুদিদিকে বড্ড ভালোবাসে।এই দুর্মূল্যের বাজারে কিছুই তো ফেলা যাবে না।চার চারটে জোয়ান ছেলে আবার তাঁরা দুজনও আছেন।এতগুলো লোকের খাবারের সংস্থান করা কম কথা নয়।রেলের চাকরিতে রোজ যাতায়াত করতে হয়।তবু শশধরবাবু দোকান-বাজার সব এক হাতে সামলে নিচ্ছেন।রান্নাবান্না করেন তিনি।ভাইরা থাকে বন্ধ বাড়িতে নিশ্চুপেআত্মগোপন করে।

ঘরের কাজকর্ম সামলে প্রতিদিন ইস্কুলে ছোটেন তিনি।স্থানীয় কাশীশ্বরী পাঠশালার হেডমিস্ট্রেস তিনি। গোঁদলপাড়ার সব লোকসর্বক্ষণ সমীহ করে চলে।আজ রাতের পর হয়তো সবকিছু জানাজানি হয়ে যাবে। ভারী অবাক হবে সবাই।

পরদিন বৃষ্টি পড়েছিল চন্দননগরে।শহিদের মৃতদেহ নিয়ে শোভাযাত্রা হয়েছিল চন্দননগরের পথে।পুলিসের ভ্যানে ওঠার সময় তাঁর মনে পড়েছিল মাখনের কথা।মনে মনে ভাবছিলেন তাঁর পাঠশালার ছোট ছোট ছাত্রীরা স্বাধীন ভারতের মাটিতে পা রাখবে তোঅজস্র মাখনের এই মৃত্যু নিশ্চয়ই ব্যর্থ হবে না।স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসে এরকম হাজারো মহিলার নিঃশব্দ অবদান হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে।

ইনি সুহাসিনী গাঙ্গুলী১৯০৯ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন।১৯২৪ সালে ঢাকা ইডেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তেই শিক্ষিকার চাকরি নিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। দেশভাগের পর প্রচার বিমুখ এই মহীয়সী নারী নানা সেবামূলক কাজে নিয়োজিত হন।১৯৬৫ সালে এক পথ দুর্ঘটনায় জখম হয়ে ভর্তি হন পিজি হাসপাতালে।না ছিলেন মন্ত্রী না কোটিপতি।আর তাই জেনারেল বেডে অবহেলায় পড়ে থেকে টিটেনাসে আক্রান্ত হলেন।২৩শে মার্চ একরাশ অভিমান নিয়ে দুনিয়া ছাড়লেন বিপ্লবীদের বড় আদরের পুঁটুদি!



তথ্যসূত্র-আবার আসিব ফিরে-বিমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়,সবলা বিপ্লবী সুহাসিনী গাঙ্গুলির কথা-সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়।


No comments