Header Ads

হীরকরাজা (উৎপল দত্ত) বাংলা ও বাঙালির গর্ব


আমি শিল্পী নইনাট্যকার বা অন্য যেকোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারেতবে আমি মনে করি আমি প্রপাগান্ডিস্টএটাই আমার মূল পরিচয় নিজের সম্পর্কে এভাবেই বলেছিলেন উৎপল দত্তহীরক রাজার দেশের হীরকরাজা, ‘জয়বাবা ফেলুনাথে র মগনলাল মেঘরাজ, ‘আগন্তুকএর মনোমোহন মিত্র, ‘পদ্মা নদীর মাঝি র হোসেন মিয়া, ‘অমানুষএর মহিম ঘোষাল, ‘দো আনজানে  চিত্র পরিচালক, ‘জনঅরণ্যে র বিশুদা এমনি কত চরিত্রেই না অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনিতিনি কেবল অভিনেতা হিসাবে বিখ্যাত ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাঙালি নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যতজ্ঞ ও সম্পাদকতিনি বাংলার শিল্পাঙ্গনে এক বিরাট বিস্ময়! তাঁর সব কিছুকে নিয়ে ভারতীয় নাট্যজগতে যে বিপুল আলোড়ন উঠেছিল, তাঁর সময়কালে আর কোনও নাট্যব্যক্তিত্বকে ঘিরে তেমনটা হয়নিতাঁর মতো আগে কেউ ছিলেন না, পরেও কেউ আসেননিপুলিশি নির্যাতন, কারাবাস, দুষ্কতীদের দিয়ে তাঁর নাটকের উপর আক্রমণ, কোনও কিছুই থামাতে পারেনি সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত এই নাট্যব্যক্তিত্বকেযেমন ছিলেন মঞ্চে, তেমনি ক্যামেরার সামনে; ঠিক তেমনি নিজেকে অমর করে রেখেছেন নাট্যকার হিসেবেতিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব



পুরো নাম উৎপলরঞ্জন দত্তজন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ, বাংলাদেশের বরিশাল জেলার কীর্তনখোলায়যদিও তাঁর পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল কুমিল্লা জেলায়কিন্তু তিনি নিজে তাঁর জন্মস্থান শিলংয়ে তাঁর মামার বাড়িতে বলে উল্লেখ করে গিয়েছেনতাই সঠিক বলা দুষ্কর আসল জন্মস্থানটি কোথায়উৎপলের বাবা গিরিজারঞ্জন দত্ত ও মা শৈলবালা রায়ের (দত্ত) পাঁচ পুত্র, তিন কন্যার মধ্যে উৎপল ছিলেন চতুর্থ সন্তানপারিবারিক ধর্মগুরু তাঁর ডাকনাম রেখেছিলেন শঙ্করবাবা গিরিজারঞ্জন ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ প্রভাবিত সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষতিনি পরবর্তী কালে জেলার হিসেবে ইংরেজ কারাগারের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক (কমান্ড্যান্ট) নিযুক্ত হনউৎপলের স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল শিলং শহরের সেন্ট এডমন্ডস স্কুলেপরে গিরিজাশঙ্কর বদলি হয়ে আসেন বহরমপুর শহরেএখানেই উৎপলের ছেলেবেলার দিনগুলো কেটেছিলছোট ভাই নীলিন ও তিনি বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেনবিপ্লবীদের ভয়ে স্কুলে যাতায়াতের সময়ে তাঁদের সঙ্গে দেহরক্ষী থাকতজেলের পাঠান রেজিমেন্টের জওয়ানদের সঙ্গে উৎপল ড্রিল করতেনএই সঙ্গই তাঁকে সময়ানুবর্তিতা শিখিয়েছিলজেল-সংলগ্ন কোয়ার্টারে সপরিবার তাঁরা থাকতেনবাড়ির সদর দরজায় মা শৈলবালার হাতে তৈরি এমব্রময়ডারি করা শেক্সপিয়রেরহ্যামলেটনাটকের পেমেনিয়াসের সংলাপ ঝুলত, ‘নেভার কোয়ারেল, নেভার লেন্ড অর বরো ইফ ইউ আর অনেস্টবোঝাই যায়, বাড়িতে পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিবেশে শেক্সপিয়রের উপস্থিতি ছিল অগ্রগণ্যমেজদা মিহিররঞ্জন কিশোর উৎপলকে শেক্সপিয়রের নাটকের গল্প পড়ে শোনাতেনবাড়িতে রেকর্ড চালিয়ে নাটক শোনার চল ছিলউৎপল সে সব নাটক মন দিয়ে শুনতেনতাই তিনি মাত্র ছবছর বয়সেই শেক্সপিয়রের নাটকের সংলাপ মুখস্থ বলতে পারতেনবড়দিদির মাধ্যমে হিন্দুস্তানী মার্গ সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় বহরমপুরের বাড়িতেইআরও পরে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময়ে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের সংস্পর্শে আসেনতখনও নাটক তাঁকে টানেনিতিনি চেয়েছিলেন কনসার্ট পিয়ানিস্ট হতেকিন্তু শিক্ষিকা মিসেস গ্রিনহল তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর হাতের আঙুলের দৈর্ঘ্য বারিচকম হওয়ায় তাঁর পক্ষে কনসার্ট পিয়ানিস্ট হওয়া সম্ভব নয়

এর পরে তিনি চলে আসেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে, নবম শ্রেণিতেএই স্কুল ও কলেজ জীবন উৎপল দত্তকে তৈরি করে দিয়েছিল১৯৪৫-এ তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হনকলেজে তাঁর কাছে সবচেয়ে আকর্ষক ছিল গ্রন্থাগারটিবিভিন্ন বিষয়ের বই তাঁর সামনে মেলে ধরেছিল জ্ঞানের বিপুল ভাণ্ডারবন্ধু পুরুষোত্তম লালের ভাষায়, “উৎপল হল বর্ন ব্রিলিয়ান্টওই বয়সেই সে শেক্সপিয়রের জগৎকে যেমন আবিষ্কার করেছিল, তেমনই মার্ক্স, লেনিন, স্তালিন, হেগেল, কান্টও তাঁর আয়ত্তে ছিলকলেজ পত্রিকার জন্য তিনিবেটি বেলশাজারনামে প্রথম ইংরেজি নাটকটি লিখেছিলেনএ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়েও লিখতে শুরু করেনসেখানে যেমন ছিল শেক্সপিয়র, বার্ট্রান্ড রাসেল, রুশ সাহিত্য, তেমনই রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র| ১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগোলেরডায়মন্ড কাট্স ডায়মন্ড এ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কলেজজীবনে উৎপলের নাট্য অভিনয়ের শুরুতাঁর সহপাঠী অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন প্রতাপ রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখএই বন্ধুদের নিয়েই তিনি তৈরি করেন তাঁর প্রথম নাট্যদলদি অ্যামেচার শেক্সপিরিয়নসকারণ, দিন বদলের দামামা উৎপল তত দিনে শুনে ফেলেছিলেনতাঁর কলেজ জীবনের সময় কালে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর চারের দশক জুড়ে বিশ্বযুদ্ধ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা, উদ্বাস্তুদের ঢল, গণনাট্য, কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়া, নৌ-বিদ্রোহ ইত্যাদিতে সারা দেশ উত্তালসেই রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবেশ উৎপলকে বাধ্য করেছিল তত্ত্বগত ভাবে আয়ত্তে থাকা মার্ক্সের দর্শনকে নাট্যমঞ্চে প্রয়োগের স্তরে নিয়ে আসতে১৫ ই জুলাই, ১৯৪৯ জেভিয়ার্সের মঞ্চে তিনি শেক্সপিয়রেরজুলিয়াস সিজারউপস্থাপন করলেন চরিত্রদের ইতালীয় ফ্যাসিস্ত শাসকের পোশাক পরিয়েসমকালীন মাত্রা পেল শেক্সপিয়রের নাটকজিয়োফ্রে কেন্ডাল ও শেক্সপিয়রানা নাট্যদল সেন্ট জেভিয়ার্সে থাকাকালীনই শেক্সপিয়রেররিচার্ড দ্য থার্ড এ উৎপলের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিজের দলে টেনে নেন জিয়োফ্রে কেন্ডালদ্য শেক্সপিয়রানা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানিতে অভিনেতা হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন উৎপলপ্রথম পর্বে কলকাতা ও দ্বিতীয় পর্বে সারা দেশ ঘুরে তিনি এই দলের পেশাদার অভিনেতা হিসেবে শেক্সপিয়রের মোট আটটি নাটকে অভিনয় করেনজিয়োফ্রেকে শিক্ষাগুরু মনে করতেন উৎপলশেক্সপিয়রের নাটকে ঠিক কী ভাবে অভিনয় করতে হয়, নাটকের দল বলতেই বা কী বোঝায়, তা তাঁকে হাতেকলমে শিখিয়েছিলেন জিয়োফ্রে

শেক্সপিয়রানা দলের হয়ে অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেরদ্য অ্যামেচার শেক্সপিরিয়ানসনাট্যদলের হয়েও অভিনয় করে যাচ্ছিলেন উৎপল১৯৪৯ সালে এই দলের নাম বদলে হয়কিউব১৯৫০ এ ইউরোপ ও আমেরিকার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আবারও দলের নাম বদলে করেনলিটল থিয়েটার গ্রুপ১৯৫২ সালে এই দলে যোগ দেন রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারাএর পরই বাংলা নাটকের দল হিসেবেএল টি জিপাকাপাকি ভাবে আত্মপ্রকাশ করে হেনরিক ইবসেনের বাংলা অনুবাদগোস্টস্‌’ নাটকটি দিয়ে

উৎপল দত্ত হলেন বাংলা পথনাটকের পথিকৃৎতাঁর মতে, “পথনাটিকা হচ্ছে সেই মাধ্যম যেখানে লক্ষ মেহনতী মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও অভিনেতার রাজনৈতিক উপলব্ধি এক হয়ে বিস্ফোরিত হয় মঞ্চেসোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক শ্রেণির হাত ধরেই এর উঠে আসা১৯৫১ সালে উমানাথ ভট্টাচার্যের এক রাতের মধ্যে লেখাচার্জশীটভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রথম পথনাটকযা অভিনীত হয়েছিল হাজরা পার্কেযেখানে অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, মমতাজ আহমেদ ও পানু পাল১৯৫২ সালেপাসপোর্টথেকে ১৯৯২ সালেসত্তরের দশকপর্যন্ত দীর্ঘ একচল্লিশ বছরে উৎপল দত্ত মোট ২৫টি পথনাটক করেছিলেন কখনও কোনও কারখানার গেটে, নির্বাচনী জনসভায় বা বন্দিমুক্তি আন্দোলনে উত্তাল বাংলার বিভিন্ন মাঠে ময়দানে

এল টি জির সদস্যরা মিনার্ভা ও অন্যান্য মঞ্চে নাটক করে যাচ্ছিলেনএমনই এক সময়ে ধানবাদ অঞ্চলের জামাডোবায় চিনাকুড়ি ও বড়াধেমো কয়লাখনিতে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটলখাদে আগুন ধরে যায়মালিক আটকে পড়া শ্রমিকদের কথা না ভেবে জল ঢুকিয়ে খনি বাঁচাতে চেষ্টা করেনশ্রমিকরা মারা যানএই দুর্ঘটনার খবর রবি ঘোষ তাঁর এক আত্মীয় মারফত নিয়ে আসেন উৎপলের কাছেখবর পেয়েই তিনি ছুটে যান সেই কয়লাখনিতেসঙ্গে তাপস সেন, নির্মল গুহরায়, উমানাথ ভটাচার্য, রবি চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষহাজার ফুট নীচের সেই খনিগহ্বরে তাঁরা দুঘণ্টা ধরে ঘুরে বেড়ানজীবিত খনি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেনখনির ভিতরের বিভিন্ন শব্দ রেকর্ড করেনতার পরে সেখান থেকে ফিরে মিনার্ভার তিনতলার ঘরে বসে টানা ১৫ দিনে লিখে ফেলেন কালজয়ী নাটকঅঙ্গার  ১৯৫৯ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর এই নাটক প্রযোজনার কাহিনি আজ বাংলা নাট্যজগতে মিথে পরিণত হয়েছেএর পরে এল টি জি নাট্যদলকে আর পিছনে ফিরতে হয়নিউৎপল দত্ত তার পর থেকেগ্যালিভার’-এর মতোই বিচরণ করেছেন বাংলার নাট্যজগতে এই ভাবেই ক্রমশ মিনার্ভায়ফেরারি ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘চৈতালী রাতের স্বপ্ন’ ‘প্রোফেসর মামলকইত্যাদি নাটক পার হয়ে ১৯৬৫ সালের ২৮ শে মার্চ মঞ্চস্থ হয়েছিল আর এক সাড়া জাগানো নাটককল্লোল১৯৪৬-এর নৌ-বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে এই নাটক বিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকে যে অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের সূচনা করেছিল, তা আজও নজিরবিহীনউৎপল দত্তের বয়স তখন ৩৬

স্বাভাবিক কারণেইকল্লোল’-এর বিরুদ্ধে সরকারি ক্রোধ নেমে এসেছিলপত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্রে নাটকটি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিলবলা হয়েছিল, মিনার্ভা থিয়েটারকমিউনিস্টদের বেলেল্লাপনার আখড়ায় পরিণত হয়েছেএই নাটকের বিজ্ঞাপন ছাপা নিষিদ্ধ করেছিল তৎকালীন কলকাতার প্রায় সব খবরের কাগজকিন্তু তাপস সেনের করাকল্লোল চলছে চলবেপোস্টার ও মন্মথ রায়, সত্যজিৎ রায় প্রমুখের পাঠানো প্রতিবাদপত্রে নাটকের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ভারত রক্ষা আইনে উৎপল দত্তকে গ্রেফতার করে জেলবন্দি করা হয়তাঁর মুক্তির দাবিতে দেশ ও আন্তর্জাতিক স্তরে সরব হয়েছিলেন শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরাকলকাতার রাস্তায় মিছিল বেরিয়েছিলতাঁর মুক্তির পর ৭ ই মে, ১৯৬৬ ময়দানে আয়োজিত হয়েছিলকল্লোল বিজয় উৎসব

নকশাল আন্দোলন উৎপল দত্তকে আগ্রহী করেছিলতাঁর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বামপন্থী মহল প্রশ্ন তুলেছিলতাঁর সহযোদ্ধারা তাঁকে বর্জন করেছিলেনআন্দোলনের প্রথম সারির নেতা হিসেবে উৎপল আত্মপ্রকাশ করেছিলেনআজীবন মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ও দায়বদ্ধ শিল্পী নকশাল রাজনীতির জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলেন১৯৬৭ সালেরতীরনাটক যার ফলশ্রুতিতিনি আবারও সরকারি নজরদারির আওতায় চলে আসেনতাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়তাঁকে আত্মগোপন করতে হয়১৯৬৭ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর মুম্বাই শহর থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়একটিআর্মস ডিল এর সূত্রে তিনি নাকি মুম্বই গিয়েছিলেনতখন ইসমাইল মার্চেন্টেরগুরুছবিরও কাজ চলছিলসেই শুটিংয়ের আড়ালে পার্টির জন্য ওই আর্মস ডিলের কাজ করছিলেন তিনিতাজ হোটেল থেকেই স্বেচ্ছায় ধরা দেন উৎপলকিন্তু বন্দি হয়ে জেলে বসে থাকলে তাঁর পক্ষে শুটিং চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হত নাঅনেক টাকার ক্ষতিপূরণও দিতে হতসেই অবস্থা এড়াতে ইসমাইল মার্চেন্ট সরকারি উচ্চমহলে যোগাযোগ করে অভিনেতার জামিনের ব্যবস্থা করেনজামিন পাওয়ার শর্ত হিসেবে তাঁকে মুচলেকা দিতে হয় যে, তিনি আর কখনও কোনও রকম রাজনৈতিক নাটক লিখবেন না ও করবেন না  অবশ্য তাও তিনি বাকি জীবনে রাজনৈতিক নাটক লেখা ও মঞ্চস্থ করা থেকে বিরত হননি

নকশাল রাজনীতি থেকে পরে নিজেকে সরিয়ে নিলেও উৎপল দত্ত জীবনের ওই পর্বে ছিলেন রাজনৈতিক ভাবে নিঃসঙ্গনিজের দল এল টি জি তাঁকে বহিষ্কার করেছিলসেই নিঃসঙ্গতা ও সংকট মুহূর্তে তিনি মঞ্চস্থ করেনমানুষের অধিকারনামে আরও একটি কালজয়ী নাটকযদিও এই নাটক নকশালপন্থীদের সমালোচনার মুখে পড়েছিলঅতি-বামদের বৈরিতা শুরু হয়তার প্রভাব এসে পড়ে এল টি জি দলের মধ্যেসাত সদস্য দলত্যাগ করেনউপদলের জন্ম হয়ফলে ১১ বছর ধরে চালিয়ে যাওয়া একটি অন্যধারার পেশাদার থিয়েটারের ইতি ঘটিয়ে উৎপল দত্ত মিনার্ভা ছেড়ে বেরিয়ে আসেনগড়ে তোলেনবিবেক নাট্যসমাজ’, যা পরবর্তী কালে নতুন দলপিপলস লিটল থিয়েটারবাপি এল টিনামে পরিচিতি পায়১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর রবীন্দ্র সদনে অভিনীত হয় দলের প্রথম নাটকটিনের তলোয়ারএই নাটকে বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসটি সুন্দর ভাবে ধরা পড়লেওঅশ্লীলঘোষিত হওয়ায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিলএর পরেসূর্যশিকার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘টোটা’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’, ‘তিতুমীর’, ‘স্তালিন ১৯৩৪’, ‘লালদুর্গ’, ‘জনতার আফিমপেরিয়ে তিনি পৌঁছেছিলেনএকলা চলো রেনাটকেযে নাটকে তিনি শেষ বারের মতো মঞ্চে নামেন

নাটক ও যাত্রা আমাকে সৃষ্টির আনন্দ দিলেও চলচ্চিত্র দিয়েছিল বেঁচে থাকার রসদ, মানে টাকাহিন্দি চলচ্চিত্র আমাকে সর্বভারতীয় অভিনেতা হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিলমধু বসুরমাইকেলছবিতে মাইকেল মধুসূদনের ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে উৎপল দত্তর চলচ্চিত্র জীবনের সূচনাঅসংখ্য বাংলা ও হিন্দি বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করলেও তাঁর নিজের ভাললাগার ছবিগুলি তৈরি হয়েছিল অজয় কর, তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, শক্তি সামন্তর মতো পরিচালকের ছবি দিয়েতিনি যে কত বড় কৌতুকাভিনেতা, তার পরিচয় ছড়িয়ে আছে এদের ছবিতেআবার মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, গৌতম ঘোষের ছবিতে তাঁর অভিনয় একেবারে অন্য গোত্রেরমৃণাল সেনেরভুবন সোমতাঁকে চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলতবে যাঁর ছবিকে তিনি বারবার কুর্নিশ করেছেন প্রথম থেকেই, তিনি সত্যজিৎ রায়পথের পাঁচালিবাজন অরণ্যদেখে সত্যজিৎকে লেখা তাঁর আবেগরুদ্ধ চিঠি রয়েছেসত্যজিৎকে তিনি ডাকতেনস্যারবলেসত্যজিৎও মুগ্ধ ছিলেন উৎপলের প্রতিভায়বলেছিলেন, ‘উৎপল যদি রাজি না হত, তবে হয়তো আমিআগন্তুকবানাতামই না’ ‘আগন্তুকছবিতে উৎপলকে নিজের প্রতিভূ হিসেবেই ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় মৃণাল সেন পরিচালিতভুবন সোমএ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান তিনিহিন্দি ছবিতে কমেডি চরিত্রে দারুণ জনপ্রিয়তা পান উৎপল দত্তকমেডি চরিত্রে অভিনয়ের জন্যগোলমাল’(১৯৮০), ‘নরম গরম’(১৯৮২) রঙ বিরঙ্গি’(১৯৮৭) ছবির সুবাদে তিন বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পানসাহেব’(১৯৮৬) ছবিতে অভিনয়ের জন্য পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান ফিল্মফেয়ার আসরে ১৯৯৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের 'আগন্তুক' ছবিতে অভিনয়ের জন্য পান বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেরা অভিনেতার পুরস্কারথিয়েটারে অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে সংগীত নাটক অ্যাকাডেমির ফেলোশিপ পান

হিন্দি ও বাংলা বাণিজ্যিক ছবিতেও তিনি ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘আগমন’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘অমানুষ’, ‘গুড্ডি’, ‘শৌখিন’, ‘বারসাত কি এক রাত’, ‘চৌরঙ্গি’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘ইনকিলাব’, ‘কিসিসে না কেহনা’, ‘হামারি বহু অলকা’, ‘প্রিয়তমা’, ‘আপনে পারায়ে’, ‘জুলি’, ‘দ্য গ্রেট গ্যাম্বলার’,  ইত্যাদি অসংখ্য বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন এই অভিনেতাবাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবিঅবিচার’-এ খলচরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন তিনিগৌতম ঘোষ পরিচজালিতপদ্মা নদীর মাঝি' সিনেমাতেও তাঁর অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছেসপ্তপদীছবিতে 'ওথেলো' নাটকের দৃশ্যে উত্তম কুমার অভিনীত কৃষ্ণেন্দু চরিত্রের নেপথ্য কণ্ঠ ছিল উৎপল দত্তেরকারণওথেলোনাটকে সে সময় তাঁর বিকল্প অন্য কাউকে ভাবাই যেত না

বাংলা নাটকে যেমন মাইকেলকে নতুন ভাবে এনেছিলেন গিরীশ ঘোষ, তেমনই বার্টোল্ড ব্রেখটকে যুক্ত করেছিলেন উৎপল দত্তনিজেই বলেছেন, তাঁর উপরে প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছিল, সোভিয়েত রাশিয়ার নিকোলে পাভলোভিচ অখলোপকভ-এরসৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “সিনেমা নয়, তাঁর আসল জাত চিনিয়েছে নাটক নির্দেশক উৎপল দত্তর কর্মকাণ্ড শিশির-উত্তর বাংলা রঙ্গমঞ্চকে যতখানি সমৃদ্ধ করেছে, ইতিহাসই সেই অতুলনীয় সম্পদের কোষাগার হয়ে থাকবেউৎপল দত্তের সঙ্গে নাটকে কাজ করতে চেয়ে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন সৌমিত্রআন্তন শেফারেরস্লিউথনাটকটি তাঁকে অনুবাদ করতে দেন উৎপলকথা ছিল, ওই নাটকে দুজনে অভিনয় করবেনকিন্তু তা আর হয়নিপরে সেই নাটকটিকটিকিনামে সৌমিত্র করেছিলেন কৌশিক সেনের সঙ্গে  উৎপল দত্তের সঙ্গে কাজ করার স্মৃতি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে নাটক, চলচ্চিত্র ও যাত্রার অনেক অভিনেতা ও পরিচালকের মনেকন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার মনে হত, “মহলার সময় বাবা যেন এক যুদ্ধের সেনানায়কঅভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ তাঁকে গুরু মানতেনরবি ঘোষ বলতেন, “উৎপল দত্ত ছিলেন সারা ভারতের শ্রেষ্ঠস্টেজ স্টলওয়ার্টস্টেজ প্রোডাকশনের এ টু জ়েড জানতেনআমার অভিনয়ের বেসিক ট্রেনিং তো ওঁর কাছেই পাওয়াতরুণ মজুমদারের মনে আছে, “ওঁরশ্রীমান পৃথ্বীরাজছবির রায় সাহেবের চরিত্রটা এত পছন্দ হয়েছিল যে, এগ্রিমেন্ট পেপারে সই করে পারিশ্রমিকের জায়গাটা ফাঁকা রেখে ফেরত পাঠিয়েছিলেনফ্লোরে মেকআপ নিয়ে পাঁচ মিনিট আগেই উপস্থিত হতেনহাতে থাকত মোটা মোটা বইশটের ফাঁকে পড়তেনডাক পড়লেই উঠে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘ইয়েস স্যার

নাট্যচর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি দীনবন্ধু পুরস্কার, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেননানা অভিমানের জায়গা থেকে ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মভূষণ উপাধি ও সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন১৯৯৩ সালের ১৯ শে অগস্ট ৬৪ বছর বয়সে উৎপল দত্তর জীবনাবসান হয় 




No comments