Header Ads

বাংলা ও বাঙালির গর্ব স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবক সুধাংশু বিশ্বাস



স্বদেশী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি ঘর করেছিলেন তিনি চিরবিপ্লবী, বিপ্লব তাঁর রক্তে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছেন। বোমা-বন্দুক নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দিতেন ইংরেজদের হাত থেকে বাঁচতে কুয়োর মধ্যে লুকিয়ে রাত কাটিয়েছিলেন তারপর ইংরেজ পুলিশের হাতে ধরা পরে জেলও খেটেছেন। জেলে বরফের উপর শুইয়ে রেখে তাঁর উপর ব্রিটিশরা করেছিল অকথ্য অত্যাচার। মুখ বুঁজে যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। কিন্তু ব্রিটিশরা মুখ দিয়ে কারও নাম বের করতে পারেনিতিনি জেলে অনশন করেছেন। তারপর জেল থেকে ছাড়াও পেয়েছেন কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই থামেনি। তিনি ১৯৪৭ সালে নিজের চোখে দেশ স্বাধীন হতে দেখেছেন। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন দেশ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে যেতে পারে তবে দেশ মুক্তি পায়নি অনাহার, ক্ষুধা, অশিক্ষা, দারিদ্র ইত্যাদি সমস্যা থেকেতিনি তাঁর বাকি জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলার অবহেলিত, লাঞ্ছিত, নিরন্ন অনাথদের মানুষদের সেবায়। তিনি বাংলা ও বাঙালির গর্ব তিনি সুধাংশু বিশ্বাস তিনি প্রচার মাধ্যম থেকে নিজেকে দূরেই রাখতেন। অধিকাংশ বাঙালি তাঁকে চেনে না। এমনকি উইকিপিডিয়াতেও তাঁর নামে কোনো পেজ নেই। কিন্তু সুধাংশু বাবুর এই কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার২০১৮ সালে সুধাংশু বাবু দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা "পদ্মশ্রী" সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।

১৯১৮ সালে কলকাতা থেকে ৩৫ কিমি দূরে বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার রামকৃষ্ণপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুধাংশু বিশ্বাস বাবা ছিলেন চিকিৎসক স্বর্গীয় মনমোহন বিশ্বাস, মাতা মুক্তবালা বিশ্বাসরামকৃষ্ণপুর গ্রামের সবচেয়ে স্বচ্ছল পরিবারপ্যারিমোহন বিশ্বাস বাড়ির নাম বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতবিশাল বড় বাস্তুভিটে, দালান বাড়ি, বৈঠকখানা, ধানের গোলা, গোরুর গোয়াল, য়ে শয়ে বিঘের চাষের জমি, পুকুর, ফলের গাছতিনি বাবা মায়ের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন | কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে সেই স্বচ্ছলতার জীবন অবহেলায় সরিয়ে রেখে মাত্র ১২ বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন সুধাংশু বাবু তাঁর জন্মের অনেক আগে থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল বিশ্বাস পরিবারসেই নবাগত সদস্যের ক্ষেত্রেও সেই ধারার অন্যথা ঘটেনিস্বামী বিবেকানন্দের মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে শুরু হয় সুধাংশু বাবুর ছাত্রজীবন

ঘর ছাড়ার পর এক কাকার হাত ধরে পৌঁছে গেলেন বালিগঞ্জ এর ভারত সেবাশ্রম সংঘে | ঠাঁই পেলেন সাধক স্বামী প্রণবানন্দের কাছে | পড়াশোনার পাশাপাশি শিখলেন লাঠিখেলা আর কুস্তি | খাওয়াদাওয়া সারতেন অধ্যাপক সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে কসবা ও বালিগঞ্জের মাঝে বিপ্লবীদের একটি গোপন ডেরা ছিলসেখানে রোজ রাতে বড় বড় বিপ্লবীরা আসতেনকোথায় কোন ইংরেজকে শায়েস্তা করতে হবে, কোথায় বোমা মারতে হবে, কাকে গুলি করতে হবে তার গোপন ছক কষা হতকতজন কোথায় মারা গেল তা নিয়ে চলত চর্চাসেখানেই একদিন সুধাংশু বাবুর সাথে দেখা হয় বিপ্লবী বেণীমাধব দাসের। তাঁর হাত ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক কিছু শিখেছিলেন সুধাংশু বাবুসেই সময় রিভলভার ছিল নাছিল পিস্তলকিন্তু তা হাতে পাওয়া খুব সহজ ছিল নাএজন্য পরিত্যক্ত বাগানবাড়িতে ছোট সিঁদুরের টিপ লক্ষ্য করে লক্ষ্যভেদ করার জন্য রীতিমতো কঠিন পরীক্ষা দিতে হতসেই পরীক্ষার পর একবার তাঁকে  আলিপুরে ইংরেজ জেলা জজকে মারার ভার দেওয়া হলএকদিন দুপুরে আদালতে গেলেনখুব সতর্কভাবে সেখানে ঢুকে জেলা জজকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ঁলেনকিন্তু জজের বুক পকেটে একটি ডায়রি ছিলতাতে লাগলফলে জজ বেঁচে গেলেনসুধাংশু বাবু পালালেন কিন্তু বেশ কয়েকদিন পর দেশপ্রিয় পার্কের কাছে ধরা পড়লেনজেলখানার ভিতর নিকাশির মধ্যে ফেলে লাঠি দিয়ে বেদম মারা হলমুখ বুঁজে যন্ত্রণা সহ্য করতে হলকিন্তু মুখ দিয়ে কারও নাম বের করতে পারেনিতারপর ৩৩ দিন জেল হলসেখানে অনশন শুরু করলেনশেষ পর্যন্ত বয়স কম হওয়াতে জামিন পেয়েছিলেন। এরপর অনুশীলন সমিতির হয়ে একের পর এক অপারেশন চলতেই থাকেবেণীমাধব দাসের নেতৃত্বেই বীণা দাস, কল্যাণী দাস, অমীয় মণ্ডল, সুধাংশু বিশ্বাস ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা শরৎ বসুর নির্দেশেও কাজ করেছেন সুধাংশু বাবু অনেকবার জেল খেটেছেন এর জন্যে। যদিও স্বাধীনতার পরে কেটে গিয়েছিল তাঁর জেল যন্ত্রণা

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বড়বাজারে ব্যবসা করতেনব্রিটিশদের চোখ এড়াতে পুরনো দিল্লির কুতুবমিনারের কাছে এক পাঞ্জাবির আশ্রয়ে ছিলেন সুধাংশুবাবুনাম তখন গোলাম গাজিআন্ডারগ্রাউন্ডসেই পরিচয় থেকে মুক্তি মেলে স্বাধীনতারও বেশ কিছু মাস পরপরবর্তীতে রাজনৈতিক অনুসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছেন খুব সতর্ক ভাবেগ্রহণ করেননি সংগ্রামীদের ভাতাওএকসময় সেসব ছেড়ে দিয়ে বেছে নিলেন সাধুর জীবনদীক্ষা নিলেন বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মিশনের বীরজানন্দ মহারাজের কাছেএ প্রান্ত সে প্রান্ত ঘুরে ফিরে এলেন সেই জন্মভূমি নিজের গ্রাম রামকৃষ্ণপুরে লক্ষ্য একটাই স্বামীজির আদর্শ 'ম্যান মেকিং ইজ মাই মিশন' বাণীকে বাস্তবায়ন এবং অবহেলিত, লাঞ্ছিত, নিরন্ন অনাথদের অনাথ মানুষদের সেবা। সেবার মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। ১৯৭৩ সাল নাগাদ বিষ্ণুপুর থানার আওতায়, তাঁরই একক উদ্যোগে ৪০ বিঘা জমির উপর রামকৃষ্ণপুরে গড়ে উঠলরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমঅনাথ শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও অসহায় মহিলাদের নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয়। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে হাতেকলমে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন সুধাংশুবাবু। পর্যায়ক্রমে আশ্রমে তৈরি হল অনাথদের থাকার ঘর, খেলার মাঠ, স্নানের জায়গা, প্রার্থনার মন্দির, কারিগরি শিক্ষার স্থান, বৃদ্ধাবাসতাঁর হাত ধরে সুন্দরবনের বুকে ১৮ টি স্কুল তৈরি হয়েছে দুঃস্থ ছেলে মেয়েদের জন্যঅনাথ-দুঃস্থ শিশুদের উচ্চমাধ্যমিক অবধি পড়াশোনার সমস্ত ভারটাই এখন বহন করছে সুধাংশুবাবুর সুযোগ্য টিমমেয়েদের স্বনির্ভর করার জন্য সেলাই শেখানো হচ্ছে সেখানে, মোবাইল রিপেয়ারিং-এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ছেলেদেরচালু করেছেন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা | চালু করেছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্র

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন তাঁর জীবনের আদর্শ। সুধাংশুবাবুর কথায়, স্বাধীনতা আন্দোলনে বিবেকানন্দ ও নিবেদিতার অবদান অনেক বেশিযার মূল্যায়ন আজও হয়নিবয়সভারে ন্যূব্জ হলেও সেবাশ্রমই ধ্যানজ্ঞান ছিল সুধাংশুবাবুররোজ ঘুম থেকে উঠতেন ভোর পাঁচটায়। অসুস্থ হওয়ার আগে অবধি নিজে অঙ্ক করতেন আশ্রমের ছেলেমেয়েদের। ২০১৮ সালের ২৬ শে জানুয়ারী কেন্দ্রীয় সরকার ৯৯ বছর বয়সী সুধাংশু বিশ্বাসকে পদ্মশ্রী পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। ২ রা এপ্রিল রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সুধাংশু বিশ্বাসের হাতে পদ্মশ্রী পুরস্কার তুলে দেন | ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর ৯৯ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছেন সুধাংশুবাবু। একপ্রকারে প্রচারবিমুখ মানুষটি চলে গেলেন নিঃশব্দেই | শেষ যাত্রায় হাজির ছিলেন না কোন বিশিষ্ট মানুষজন, নেতা, মন্ত্রী, বুদ্ধিজীবীরা। উপস্থিত ছিলেন আবাসিক আশ্রমের কর্মী, বর্তমান ও  প্রাক্তন ছাত্ররা, আশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এবং গ্রামবাসীরা আশ্রমের সকলের কাছে তাঁর একটাই পরিচয় ছিল, তিনি ছিলেন সকলের দাদু। জীবনের এই শেষবেলায় এসে পদ্মশ্রী পেলেও আবেগে ভেসে যাননিবলেছিলেন, এখনও অনেক কাজ বাকিযেখানেই আছেন ভালো থাকবেন সুধাংশুবাবু।




No comments