Header Ads

নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী বুঝিয়ে দেন বাঙালির খালিপায়ে লাথি বুটপরা লাথির চেয়ে অধিক শ্রেষ্ঠ


সালটা ১৮৭৯ বর্তমান মোহনবাগানের মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বয়সে তিনি তখন একজন বালক। হঠাৎ একটি বল রাস্তার ওপর গড়িয়ে আসে। তিনি বলটিকে দেখতে পেয়ে তড়িঘড়ি বলটি লাথি মেরে মাঠে ফেরত পাঠিয়ে দেন। সাহেবরা চিৎকার করে মাঠ থেকে বলেছিলেন, 'কিক ইট বয়, কিক ইট।' ইনি হলেন বাঙালির মগজে ও মনে ফুটবলকে পরিচিত করার সর্বপ্রথম পুরুষ, যার নাম নগেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী। 


ভারতের ফুটবলের জনক হিসেবে তাঁকে পরিগণিত করা  হয়। ব্রিটিশদের শাসনকালে ব্রিটিশরা বাঙালিদের ভীতু, কাপুরুষ ও অকর্মণ্য ভাবতো। এই ব্রিটিশদের মুখের ওপর জবাব পায়ের মাধ্যমে দিয়েছিলেন ফুটবলার নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। বাঙালির কব্জির জোর কতটা তাঁর প্রমাণ হাড়ে হাড়ে ব্রিটিশদের টের পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আমরা সকলেই ১৯১১ সালের মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয়ের কথা জানি। কিন্তু  এর আগেও বাঙালির আরেক ঐতিহাসিক জয়ের কথা আমরা অনেকেই জানি না। যে জয়ের কারিগর ছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী নিজে৷  

নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী মাত্র ১০ বছর বয়সে মাঠে গোরা সৈন্যদের ফুটবল খেলা দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় হেয়ার স্কুলে। এখানে পড়ার সময় তিনি তাঁর সহপাঠীদের উদ্বুদ্ধ করতেন ফুটবলের ব্যাপারে৷ এক একজন সহপাঠীকে নিয়ে দল গঠন করে ফুটবল খেলতে আরম্ভ করেন তিনি। স্কুলের মাঠেই তিনি ফুটবল নিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করতে থাকেন। তবে যে বল নিয়ে তাঁরা খেলতেন সেটি ছিল রাগবি বল। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রফেসার স্ট্যাক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে নিজে একটি ফুটবল কিনে দিয়ে খেলার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এরপর তিনি ময়দানে অনেকরকম খেলার নেতৃত্ব দিতেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলার অদ্বিতীয় সেন্টার ফরওয়ার্ড হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। 

কৈশোর পার করার আগেই বেশ কয়েকটি ক্লাব গড়ে তোলেন যেমন 'বয়েজ ক্লাব' (যা ভারতের প্রথম ফুটবল সংগঠন), ফ্রেন্ডস ক্লাব, হাওড়া স্পোর্টিং ক্লাব, চুঁচুড়া ক্লাব, প্রেসিডেন্সি ক্লাব প্রভৃতি। তাঁর হাত ধরেই গড়ের মাঠে বাঙালি ক্লাবের তাঁবু পড়ে- ওয়েলিংটন ক্লাব। তিনি এই ক্লাবে ফুটবল, ক্রিকেট, রাগবি, হকি ও টেনিস খেলার ব্যবস্থা করেছিলেন।

১৮৮৭ সালে স্থাপিত শোভাবাজার ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। তাঁর সর্বোপরি প্রচেষ্টায় বিভিন্ন শ্রমজীবী শ্রেণীর যুবকেরা সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানদের সাথে একত্রিত হয়ে শরীরচর্চা করার সুযোগ পান। ১৮৮৭ সালে একজন তথাকথিত নীচু জাতের এক ছেলেকে খেলতে নামিয়েছিলেন তিনি, এই নিয়ে ওয়েলিংটন ক্লাবে ভদ্রলোক বাবু সমাজ ও এলিটদের কাছে তিনি নানা প্রকার বিদ্বেষের শিকার হন। যার ফলে তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। একটি সভা করে সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে তিনি জোরালো আওয়াজ তোলেন। তিনি বলেন "আমি বুকের রক্ত দিয়ে ক্লাব তৈরি করেছি, বংশপরিচয় নিয়ে খেলোয়াড় তৈরি করিনি৷ জাতপাত নিয়ে খেলার আসর আমি সাজাব না, তৈরি করব খেলোয়াড় জাত।" 

নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর খেলার জীবন প্রসঙ্গে মন্মথনাথ বসু একবার বলেছিলেন "ইউরোপীয়ানদের  নগেন্দ্রপ্রসাদ বেশ ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে  বাঙালিরা বুদ্ধিতে ও জ্ঞানে কোনো অংশেই তাদের চেয়ে কম যায় না। আর খেলার মাঠে যারা নগেনের কনু-এর গুঁতো খেয়েছে তাঁকে আর কিছু বোঝাবার দরকার হত না, ব্রিটিশদের তিনিই প্রথম হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেন যে বাঙালির খালিপায়ে লাথি বুটপরা লাথির চেয়ে অধিক শ্রেষ্ঠ।"  

নগেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীর চেষ্টাতে ত্রিকেটে হ্যারিসন শিল্ড প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল এবং সাহেবদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ক্লাবে দেশীয়দের প্রতিযোগিতা করার রাস্তা খুলে গিয়েছিল। ১৮৮৩ সালে ভারতীয়দের নিয়ে কলকাতায় বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। আই.এফ.এ শিল্ড গঠনে উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র ভারতীয়। ১৮৯২ সালে শোভাবাজার ক্লাব সমস্ত ইউরোপীয় ক্লাবকে পরাজিত করে ফ্রেন্ডস কাপ জয় করে।  সেই বছরই আই.এফ.এ শিল্ড খেলা হয়। ১৮৭৭ থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ অবধি তিনি ৭০০-রও বেশি ম্যাচ খেলেছিলেন।

তাঁর কাছে খেলা শুধু বিনোদনের মাধ্যম ছিলনা, শরীর ও মন দুইয়ের শক্তিবৃদ্ধির মাধ্যম ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, "দুর্বল হলে ব্রিটিশদের সঙ্গে ফুটবলেও জেতা যাবে না, পাওয়া যাবে না স্বাধীনতাও।" ইউরোপীয়ান ক্লাবের সাথে নগেনদের খেলার খবর শুনে স্বয়ং বিবেকানন্দ নগেনের খেলা দেখতে মাঠে হাজির হয়েছিলেন। শিকাগো কাঁপিয়ে বিবেকানন্দ সেই সময় সদ্য দেশে ফিরেছেন৷ বিবেকানন্দকে নিয়ে গোটা কলকাতা আপ্লুত৷  শোভাবাজার রাজবাড়ির সংবর্ধনাসভায় তিনি নগেন্দ্রপ্রসাদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "ওঁর মতো মানুষ, ওই রকম মরদ চাই।"  

নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। দেড়শো বছর আগে যে মানুষটা ঔপনিবেশিকতা, সংকীর্ণতা ও জাতপাত ভঙ্গ করে বাংলার যুবকদের ক্রীড়াগত দিক দিয়ে উন্নত করার লক্ষ চেষ্টা করে গেছেন তারপরও বাঙালি তাঁকে মনে রাখেনি। তিনি অজানার আড়ালে থেকে গেলেও ফুটবলে বাংলা যতবার ইতিহাস তৈরি করেছে ততবারই তিনি জিতে গেছেন।  নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর অবদান সমগ্র বাঙালিকে মনে করিয়ে দিতে পরিচালক ধ্রুব বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরে তৈরি হয়েছে বাংলা ছবি 'গোলন্দাজ।' 

তথ্যসূত্র- সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, এ সোশ্যাল হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ফুটবল : স্ট্রাইভিং টু স্কোর (বোরিয়া মজুমদার ও কৌশিক বন্দোপাধ্যায়), দৈনিক যুগশঙ্খ

প্রতিবেদন- সুমিত দে


No comments