Header Ads

বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ, বাংলা ও বাঙালির গর্ব রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়



ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের অধীনে ওডিশার হিরাপুরের চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ব্যস্ত ছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় ওখান থেকে মূল্যবান একটি মূর্তি চুরি যায়। সর্বেক্ষণের বড়কর্তা জন মার্শাল কৈফিয়ত চেয়ে পাঠান এবং অভিযোগ নিয়ে কিছুদিনের জন্য বরখাস্তও হন রাখালদাস কলকাতার ভারতীয় সংগ্রহশালায় নিয়ম-বহির্ভূত খরচের জন্যও একবার তিনি অভিযুক্ত হন, কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি অথচ কাজপাগল, নম্র-ভদ্র এই মানুষটির সারাজীবনে জুটেছিল নানাবিধ দুর্ভোগ জওহরলাল নেহরু তাঁর ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া বইতে মহেঞ্জোদরো- দুনিয়া কাঁপানো প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের কৃতিত্ব পুরোটাই দিয়েছেন জন মার্শালকে অথচ ক্ষেত্রে রাখালদাসের কাজকেই আজ মান্যতা দেওয়া হচ্ছে সারা বিশ্বে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সংগ্রহশালাটিও গড়ে উঠেছিল তাঁরই প্রবল উৎসাহে তৈরি করে দিয়েছিলেন পরিষদ-সংগ্রহশালার প্রথম ক্যাটালগ পূর্ব ভারতের ভাস্কর্য নিয়ে তাঁর বইটি আজও প্রামাণিক সর্বেক্ষণের প্রাক্তন আঞ্চলিক অধিকর্তা (পূর্ব ভারত) ফণীকান্ত মিশ্র মনে করেন মহান এই মানুষটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার সময় এসে গিয়েছে পদে থাকার সময়েই তিনি তাঁকে নিয়ে গবেষণা করেন ব্যাকউডস টু ওয়ার্ল্ড স্টেজ শীর্ষকে লিখেছেন একটি বই, অচিরেই প্রকাশ পাচ্ছে এটি গত জুন ভারতীয় সংগ্রহশালার কমিটি রুমে ট্রুথ আনভেল্ড: দ্য বায়োগ্রাফি অব অ্যান আর্কিয়োলজিস্ট ইন সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া/ রাখালদাস ব্যানার্জিশিরোনামে একটি অনুষ্ঠানে তিনি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের অবহেলিত নানা দিকে আলোকপাত করলেন

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮৫ সালে ১২ই এপ্রিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের কালিমাটি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব, উৎকীর্ণ লিপিতত্ত্ব প্রাচীন হস্তলিপি বিষয়ের পথপ্রদর্শক এবং সাহিত্যিক ছিলেন তিনি বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল থেকে ১৯০০ সালে এনট্রান্স পাস করেন একই বছর তিনি নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে কাঞ্চনমালা দেবীকে বিয়ে করেন রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ১৯০৩ সালে এফ. পাস করেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন ১৯০৭ সালে ইতিহাসে অর্নাস ডিগ্রী লাভ করেন ১৯১১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে এম. পাস করেন।

প্রাচীন হস্তলিপি বিদ্যা লিপি উৎকীর্ণ বিদ্যায় রাখালদাসের অবদান গুরুত্বপূর্ণ তিনি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘The Origin of the Bengali Scripts’ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থিওডর ব্লককে উৎসর্গ করেন এবং এজন্য তিনি ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাকরজুবিলী গবেষণা পুরস্কারলাভ করেন ১৯১৯ সালে (১৯৭৩ সালে পুনঃমুদ্রিত) প্রথম প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ ছিল তাম্রলিপি পান্ডুলিপির ওপর ভিত্তি করে বাংলা লিপির বিকাশ তুলে ধরার প্রথম প্রচেষ্টা তিনিই প্রথম আদি বাংলা লিপির প্রতি পন্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আদি বাংলা লিপিই পরবর্তীকালে বাংলা লিপির রূপ পরিগ্রহ করে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত তাঁর Memoir of the Asiatic Society of Bengal’- প্রকাশিত হাতিগুম্ফা নানাঘাট অভিলেখের প্রাচীন হস্তলিপি গ্রন্থখানি ভারতীয় হস্তলিপি বিদ্যার গবেষণার ক্ষেত্রে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে চিহ্নিত

রাখালদাস প্রাচীন মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস সম্পর্কিত কলা, স্থাপত্য মূর্তিতত্ত্বের গবেষণায় অনবদ্য অবদান রাখেন ‘Temple of Shiva at Bhumara’, ‘Bas Reliefs of Badami ‰es The Haihayas of Tripra and their Monuments’-এর ওপর লিখিত তাঁর তিন খন্ড ‘Memoirs of the Archaeological Survey of India’ যথাক্রমে, ১৯২৪, ১৯২৮ এবং ১৯৩১ (মরণোত্তর প্রকাশিত) সালে প্রকাশিত হয় ভারতীয় কলা তার বিভিন্ন দিকে তাঁর যে প্রগাঢ় পান্ডিত্য ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো তিনটি খন্ড রচনাগুলি ভারতীয় সকল ছাত্রছাত্রী ইতিহাসবিদদের নিকট উৎসগ্রন্থ হিসেবে এখনও অতি মূল্যবান

ভারতীয় শিল্পকলার চর্চায় রাখালদাসের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত ‘Eastern Indian Medieval School of Sculpture’ নামক গ্রন্থটি প্রায় চারশত শোভাবর্ধক চিত্র সম্বলিত গ্রন্থে রাখালদাস পূর্ব ভারতীয় কলার নির্মাণ কৌশল, উৎপত্তি বিকাশ, বৌদ্ধ ব্রাহ্মণদের দেব-দেবীদের মূর্তিতত্ত্ব, ধাতব ভাস্কর্যের কৌশল, জৈন প্রতিমা পূর্ব ভারতের মধ্যযুগীয় স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা করেন তিনি উৎকীর্ণ মূর্তিতে উল্লিখিত তারিখ তারিখবিহীন মূর্তির অভিলেখ-এর বৈচিত্রপূর্ণ্য হস্তলিপির ওপর ভিত্তি করে কালানুক্রমে পাল-সেন যুগের ভাস্কর্যকে বিন্যস্ত করেন পূর্ব ভারতীয় শিল্পকলার ওপর তিনি বাংলায় ৬টি মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেন তিনি এগুলির নামকরণ করেনগৌড়ীয় শিল্প

মূর্তিতত্ত্বে রাখালদাসের গভীর অনুরাগ ছিল ভারতীয় গবেষণার বিষয়ের ওপর তাঁর জ্ঞান ১৯০৯-১০ সালে ‘Annual Report of the Archaeological Survey of India-ˆZ 'Three Sculptures in the Lucknow Museum’ নামক শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে তিনি তিনটি ভাস্কর্যের মধ্যে একটিকে পঞ্চমুখ শিবলিঙ্গ হিসেবে যথার্থভাবেই শনাক্ত করেন তিনি তাঁর ‘Eastern Indian Medieval School of Sculpture’ বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর মূর্তি শনাক্ত করেন এবং পৌরাণিক কাহিনী যথার্থ উদাহরণসহ পাল-সেন যুগের ধ্যানমগ্ন মূর্তির ব্যাখ্যা দেন

মহেঞ্জোদারোর আবিষ্কর্তা হিসেবে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় (সংক্ষেপে আর.ডি ব্যানার্জী) একটি অতি পরিচিত নাম পশ্চিম অঞ্চলের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে তিনি গ্রিক বিজয় স্তম্ভের সন্ধানে সিন্ধু অঞ্চলে গিয়েছিলেন এবং ঢিবির শীর্ষদেশে বৌদ্ধ বিহারের উৎখননকালে তিনি এমন কতগুলি নিদর্শনের সন্ধান পান যা তাঁকে হরপ্পায় সাহানী কর্তৃক প্রাপ্ত অনুরূপ নিদর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয় ১৯২২ সালে তিনি খননকার্য শুরু করেন এসময়ে প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শনাদি আবিষ্কৃত হয় সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বেশ কিছু প্রবন্ধ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলি হলো: ‘An Indian City Five Thousand Years Ago’ (Calcutta Municipal Gazette, November, 1928); মুহেন-জোদরো (বসুমতী, ১৩৩১ বা.); ‘Prehistoric, Ancient and Hindu India’ (১৯৩৪ সালে মরণোত্তর প্রকাশিত) এবং ‘Mahenjodaro - A Forgotten Report’ (১৯৮৪)

১৯২৪-২৫ সালে পূর্বাঞ্চলে বদলি হয়ে রাখালদাস পাহাড়পুরে উৎখননকাজ চালান এবং এর রিপোর্ট ১৯২৫-২৬ সালে Annual Report of the Archaeological Survey of India-তে 'Temple of Paharpur' নামে প্রকাশিত হয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগে চাকরির শেষ দুবছরে রাখালদাস বাংলা আসামে ব্যাপক ভ্রমণ করেন এবং মহাস্থানগড় ঘোড়াঘাট অঞ্চলে অনুসন্ধান চালান এবং মুর্শিদাবাদ ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ পরীক্ষা করেন তিনি প্রথমবারের মতো আসামের প্রাচীন মধ্যযুগের প্রাথমিক সময়ের ভাস্কর্য কাঠামোগত ধ্বংসাবশেষসমূহের প্রতি পন্ডিতদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন এবং তেজপুরের নিকটস্থ দহপর্বতিয়ার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের দরজা-বাজুর ভাস্কর্য আবিষ্কার করেন

মহেঞ্জোদারো সভ্যতার সুপ্রাচীন ধংসাবশেষ আবিষ্কার তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি কুষান সম্রাট কণিষ্ক সম্পর্কে তিনি যে সব তথ্য আবিষ্কার করেন তা প্রামান্য বলে বিবেচিত হয়েছে বাংলায় পাল রাজবংশ সম্পর্কিত বহু তথ্য তিনি আবিষ্কার করেনতাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-‘ খন্ডে বাঙ্গালার ইতিহাস, ‘পাষাণের কথা, ‘ত্রিপুরী হহৈয় জাতীর ইতিহাস, ‘করুনা, ‘ব্যতিক্রম, ‘অসীম, ‘পক্ষান্তর, ‘ভূমারার শৈবমন্দির, ‘শশাঙ্ক, ‘ধর্মপাল, ‘প্রাচীন মুদ্রা ইত্যাদি। তিনি লেখমালানুক্রমণী নামে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাপ্ত প্রস্তরখোদিত লিপির বর্ণনামূলক সংকলন গ্রন্থ সম্পাদনা করেন এছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর বাংলা ইংরেজি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩০ সালের ৩০ মে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে কলকাতায় তাঁর অকাল মৃত্যু হয়।



তথ্যসূত্র-উইকিপিডিয়া,আনন্দবাজার 


No comments