Header Ads

মানিকতলা বাজারের জন্ম হয়েছিল গরিবের রক্তঝরা ও গণবিক্ষোভে


মানিকতলা বাজারের জন্ম হয়েছিল জুলুম, গরিব মাছ ব্যাপারির পিঠে লাঠির ঘায়ে রক্ত ঝরা, মাছের ঝাঁকা কাড়ার প্রতিবাদে। বাজারের জন্মবৃত্তান্তে আছে মর্মস্পর্শী কাহিনী।

মানিকতলা বাজার নিশ্চিতভাবে কলকাতার অন্যতম বড় আর অভিজাত বাজার হলেও শহরের অন্য অনেকগুলি পুরনো বাজারের থেকে বয়সে একটু কম, তবে এই বাজারের জন্ম রহস্যের নেপথ্যে আছে গরিবের রক্ত ঝরা, মানুষের গণবিক্ষোভ। ক্ষীরোদ হালদার নামে এক ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীর পিঠে সিমলা বাজারের কেয়ারটেকার শের সিং-এর সজোরে লাঠির প্রহার, তাঁর যন্ত্রনা ও আর্তনাদের মর্মস্পর্শী এক কাহিনী৷


মানিকতলা বাজার হয়তো কোনওদিন জন্মগ্রহণ করত না, যদি সিমলা বাজারের জমিদারের কর্মীরা গরিব চার-পাঁচ জন জেলের মাছ কেড়ে তাড়িয়ে না দিত। সেকালে যারা মাছের বাজার গুলিতে স্থায়ীভাবে বসে মাছ বিক্রি করতেন তাদের একটু বেশি কড়ি গুনতে হত, আর যারা মাঝে-মধ্যে উটকো এসে ঝাঁকা করে মাছ বিক্রি করতে আসতেন তাদের এক আনা কর দিতে হতো৷ এসব রেটের কোনও ধরা বাঁধা একটা নিয়ম ছিল, সেকথা বলা যাবে না,..বরং বিভিন্ন বাজারের পেয়াদারা বেশ চড়া হারে জোর-জুলুম করে খাজনা আদায় করত৷

সরকারি নথিপত্রেরে রেকর্ড বলছে এই জবরদস্তি টাকা আদায়ে বেশ বদনাম ছিল সিমলা বাজারের৷

ক্ষীরোদ হালদার নির্দিষ্ট করে কোনও বাজারে না বসলেও কোনওদিন পোস্তার বাজার, কোনওদিন লালাবাবুর বাজারে মাছ বিক্রি করতেন৷ তার সম্বল বলতে ছিল একটা ছোট জাল যা পেঁচিয়ে ফেলতে হয়৷ বৃষ্টি-বাদলের দিনে পুকুর থেকে উজিরে ওঠা মাছ নিয়ে সোজা বাজারে চলে আসে, তাতে কিছু সুবিধে থাকলেও রোজ দিন আর বর্ষা হয় না৷ বর্ষার দিন হলে পুকুরের জ্যান্ত কই, মাগুর, শিঙি একটু চড়া দামে বেচে নুন, তেল, চাল, ডাল কিনে বাড়ি যায়। বাড়তি উপার্জন হলে আট বছরের কন্যা ক্ষান্তমনির জন্য কেনে দুটো জিলিপি কি খুরজা৷  অবশ্য সেদিন ক্ষীরোদ হালদারের দিনটা মোটেও ভাল গেল না, সিমলা বাজারে মাছের ঝাঁকা নামিয়ে সবে মাত্র বসেছে প্রায় সাথে সাথে খাজনা তোলা বাবু, কেউ বলে সরকার, মাছের বাজারের ঢিপির ওপর দাঁড়িয়ে বেশ জোরে বলল যারা উঠকো, মাছ বিক্রি করতে এসেছে তারা এক সিকি করে খাজনা দেবে৷

এক সিকির কথা শুনে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল বাজারে  মাছের ব্যাপারিদের মধ্যে৷ জোরালো প্রতিবাদ এল তাদের থেকে—কেমন করে হয়! একেবারে এক আনা থেকে চার আনা! কয়েকজন বললেন সবাই গরিব মানুষ, মরে যাব। সরকারের অবশ্য সেসব কথায় কোনও হেলদোল নেই। জোরালো এক হুঙ্কারে সমবেত কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিলেন, পরিস্কার বললেন তারা জাহান্নামে যাক, বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাছ বিক্রি করুক, এই বাজারে বসলে ওই চার আনা'ই  দিতে হবে৷ এসব শুনে ক্ষীরোদের মাথা গেল গরম হয়ে, সে যে গরিব মানুষ সেসব কথা মুহুর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল, চিৎকার করে বলল সেদিন এক আনার ওপরে আরও দুটি পয়সা চাইলেন সেটাও দিয়েছি, এসব কি জমিদারবাবু পায়! নাকি ওই সরকারের ট্যাঁকে যায়৷ ব্যস,সেকথা শুনে সরকারের রক্ত গরম হয়ে গেল, গরিব উটকো মাছ ব্যাপারি,যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা, উন্মাদের মত হয়ে সরকার হাঁক পাড়লেন শে..র সিং৷ পিতলের পাত বাঁধানো পাকানো লাঠি নিয়ে ছুটে এল সে, তাকে নির্দেশ দেওয়া হল  ক্ষীরোদ কে আচ্ছা করে লাঠিপেটা করে, সব মাছ যেন কেড়ে নেওয়া হয়৷

প্রতিবাদ করেছিল ক্ষীরোদ, মর্মস্পর্শী ভাষায় বলল কেন তাঁর মাছ কেড়ে নেওয়া হবে? সে কথা দিচ্ছে আর কোনওদিন এই বাজারে মাছ বিক্রি করতে আসবে না, মাছের ঝাঁকাটা কে সন্তানের মত বুকে আগলে থাকে৷ ওদিকে সরকার সেই ঝাঁকা কাড়বেই, দু'জনের মধ্যে টানাটানি চলছে, তখন শের সিং ছুটে এসে ক্ষীরোদের পিঠে দুম করে বসিয়ে দিল সজোরে লাঠির এক ঘা৷ পিঠটা যেন বেঁকে গেল যন্ত্রনায়, আর্তনাদ করতে করতে ক্ষিরোদ বেরিয়ে এল বাজার থেকে৷ এই ঘটনায় বাজারে বেশ শোরগোল পড়ে গেল, বেশিরভাগ দোকানদাররা মজা উপভোগ করছিলেন। কেউ তেলা মাথায় তেল দিয়ে সরকার মশাই কে বলে দিলেন ছোটলোকের কত বড় স্পর্ধা৷ তবে ক্ষীরোদের জন্য সহানুভূতির অভাব ছিল না। তাঁর উপর জুলুমের প্রতিবাদে বাজার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন সব মাছ-আনাজের উটকো দোকানদার৷ ক্ষিরোদ বুঝতে পেরেছিল সে একা নয়৷ সিমলা বাজারের একটু দূরে একটা ফাঁকা মাঠ ছিল সেখানে অনেক মাথা মিলে শলা পরামর্শ করলেন৷

কি হয়েছিল সেই মিটিংয়ে সেই তথ্য না জানা গেলেও পুরসভার রেকর্ড বলছে তাঁরা দল বেঁধে গিয়েছিলেন ১৫৯ মানিকতলা স্ট্রিটে৷ এখানে ক্ষীরোদ কালেভদ্রে মাছ হয়ত বিক্রি করেছে! সেই সুত্রে মালিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল৷ তিনি সব শুনে বলেছিলেন তোরা কেন সিমলা বাজারের মালিকের কাছে না গিয়ে আমার কাছে এসেছিস! ক্ষীরোদ অবশ্য বিনয়ের সুরে তাঁর কাছে আর্তি জানিয়ে বলেছিল বাবু ওই মস্ত মাঠে একটা বাজার বসিয়ে দিন না, ওটা যে পড়ে আছে৷ সেই আর্তিতে তিনি প্রাথমিক ভাবে সাড়া দিলেন না, বললেন ওসব হ্যাপা তার পোষাবে না, নিত্যদিন কর্পোরেশানে ছোটাছুটি করতে হবে৷ অবশ্য ক্ষিরোদদের মুখের অন্ধকার দেখে পিছন থেকে ডেকে বলেছিলেন সিমলা বাজারের মালিকের কাছে অবশ্যই তারা যাবে, আর কি হল সেটা যেন তাকে জানিয়ে যাওয়া হয়৷  তিনিও এই গরিব মানুষগুলোর ওপর অত্যাচারে মনে মনে বেশ কষ্ট পেয়েছেন৷ লাগাতার বেড়ে যাওয়া খাজনার বিরুদ্ধে হয়ত ক্ষীরোদের মত অনেক উটকো মাছ-আনাজের কারবারিরা সিমলা বাজারের মালিকের বাড়ি ঘেরাও করেছিল! হয়ত পাইক বরকন্দাজ নিয়ে না হলে কোম্পানি গভর্ণমেন্টের পুলিশের সাহায্যে সেই সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা হয়েছিল! নিশ্চিতভাবে দোকানিরা বিতাড়িত হয়ে এসেছিলেন ১৫৯ নম্বরের মালিকের কাছে৷ আর সেই ভদ্রলোকটি শুধু ঐশ্বর্যের মালিক ছিলেন না,তাঁর হৃদয়ে ছিল ঐশ্বর্য, গরিব দোকানিদের ওপর নির্মম অত্যাচারে ব্যথিত হয়ে যে দুঃসাহসিক কাজ তিনি করেছিলেন, সেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ পুরসভার বার্ষিক বিবরণীতে,— 'on the 16th october 1881 a new Market was suddenly opened without any preparation on the land belonging to BABOO ONATH NATH DEY, 159 Manicktola Street. পরে অনেক ঝক্কি ঝামেলার মধ্য দিয়ে গিয়ে দিনরাত পরিশ্রমে অনাথবাবু গড়ে তুলেছিলেন মানিকতলা বাজারের বিশাল বাড়ি৷ আর ওই টাওয়ার ঘড়ি কি অগ্রজ হগ মার্কেটের প্রভাবে! কে জানে! শুধু এই কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় মানিকতলা বাজার তৈরি হয়েছিল গরিব প্রতি জুলুমের প্রতিবাদে, গরিব জেলেদের সহায় হয়েছিলেন বিবেকবান অনাথনাথ দে।

প্রতিবেদন- অরুণাভ সেন 

তথ্যসূত্র- কলকাতার কলহকথা, সুভাষ সমাজদার।


No comments