Header Ads

ভারতে বাঙালি ক্রমশ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়ার দিকে এগোচ্ছে


বহু মানুষের বর্তমানে আশঙ্কা বাংলা ভাষা কী ভবিষ্যতে ধ্বংস হয়ে যাবে? সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে বাংলাদেশের এক বিশেষ সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নটি করা হয়েছিল। তিনি উত্তরে বলেন "বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা আর ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা বাংলা৷ এশিয়ার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম। এতোবড়ো ভাষা কখনো ধ্বংস হতে পারে না।"


একই প্রশ্ন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকেও করা হয়েছিল। তিনিও স্পষ্ট উত্তর দেন "বাংলা ভাষা কখনো ধ্বংস হতে পারে না৷ যে ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আর ভারতের দ্বিতীয় ভাষা, সেই ভাষা কখনোই ধ্বংস হবে না।" বহু সাহিত্যিক ও গুণী মানুষ বাংলা ভাষাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন৷ বাংলা ভাষা ধ্বংস হোক তাঁরা চায়না। নিজেদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা মনে করেন বাংলা ভাষা কখনো ধ্বংস হতে পারেনা৷ কিন্তু বর্তমানে বাঙালিরা বাংলা ভাষাকে যে-রকম ভাবে অবহেলা করছে তাতে কী বাংলা ভাষা সুরক্ষিত থাকবে? বাংলার গুণী মানুষেরা প্রতিদিন ভাষার জন্য বাঁচেন এবং ভাষার জন্য স্বপ্ন দেখেন। লক্ষ্য রাখতে হবে তাদের স্বপ্ন যেন না ভেঙ্গে যায়। 

বাংলার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে যেটা দেখা যাচ্ছে, তা হলো গ্রাম-বাংলাতে এখনও বাংলা ভাষা সুরক্ষিত। গ্রাম-বাংলার মানুষ নিজস্ব টানে বাংলা বলেন৷ বাংলা বলতে দ্বিধা নেই গ্রাম-বাংলার মানুষজনদের। বাংলা বলতে তারা যথেষ্ট গর্বই করে থাকে। তবে ইদানীং শহুরে প্রভাব মারাত্মক ভাবে গ্রামের ওপর পড়ছে। গ্রাম-বাংলারও বহু মানুষ শহরের লোকেদের মতো হিন্দি বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছে। সংখ্যাটা একটু কম হলেও আগামীদিনে হয়তো সংখ্যাটা বেড়ে যাবে। শহরে লোকেদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে নিয়ে গর্ববোধ খুব একটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। শহর ও গ্রামের মধ্যে তফাৎ একটাই গ্রামের লোকেরা বাংলার যে-কোনো অঞ্চলে বাংলা বলে সে বাইরের রাজ্যের লোক হোক বা এখানকার কিন্তু শহরের লোকেরা নিজেদের মধ্যেও বিজাতীয় ভাষাতে কথা বলে। শহুরে এলিট ও গ্রামের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় বাংলা ভাষা থেকে নিজেদের দূরে সরাচ্ছে। নিজের ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম ও সিবিএসসি স্কুলে ভর্তি করছে। যাতে তারা আন্তর্জাতিক জীবনযাপন করতে পারে। 

বিশেষ শ্রেণীর বাঙালির মধ্যে প্রায়শই একটা কথা শোনা যায় যে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে ইংলিশ ভালোভাবে আয়ত্ত করলে নাকি আন্তর্জাতিক জীবনযাপন করা যায়৷ এরা একটা জিনিস বোঝেনা যে আন্তর্জাতিক জীবনযাপন বলে কিছু হয়না। পশ্চিমী সভ্যতার অনুকরণকে আসলে তারা আন্তর্জাতিক বলে থাকে। ইংরেজি ভাষাকে তারা আন্তর্জাতিক ভাষা মনে করে। সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগের ভাষা হিসেবে ইংরেজির প্রচলন থাকলেও শুধু ইংরেজিকে আন্তর্জাতিক ভাষা বলা যায়না। বাংলা, তামিল, তেলুগু, জার্মানি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, পর্তুগীজ সবই কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাষা। আপনি জার্মানিতে যান সেখানে গবেষণার কয়েকটি বিশেষ কাজ ছাড়া সবক্ষেত্রেই জার্মানি জানা বাধ্যতামূলক। সূদুর ফ্রান্সেও একই অবস্থা। এমনকি স্পেন ও চিনের মতো দেশেও একই অবস্থা। তারা যে আন্তর্জাতিক  জীবনযাপনের কথা বলে তা পশ্চিমের দেশগুলোর জীবনযাপন। এই পশ্চিমী সভ্যতাকে যদি পুরোপুরি আপনারা অনুকরণ করতে চান, তাহলে আপনাকে যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে তা হলো ভাষা৷ কারণ পশ্চিমী সভ্যতার মধ্যে জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশও পড়ে। মনে রাখতে হবে পশ্চিমের দেশগুলো মাতৃভাষার প্রতি  সচেতন। ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষার যে বিশ্বব্যাপী প্রসার তার পিছনে কাজ করেছে তাদের মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্ব। তারা আজকে এতোটা উন্নত দেশ হওয়ার পিছনেও অবদান আছে মাতৃভাষার। অতএব আপনাকে আন্তর্জাতিক হতে হলে বাংলা ভাষা শিখে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক হতে হবে। নচেৎ আন্তর্জাতিক হওয়া একেবারেই সম্ভব নয়।

পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও ঈশান বাংলা সব জায়গাতে বাংলা ভাষা আজ অবহেলিত। প্রতিদিন বন্ধ হচ্ছে বাংলা মাধ্যমের বিভিন্ন স্কুল। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলা বললে জরিমানা করা হচ্ছে। রাজ্যের প্রতিটি বড় শহর ও শিল্পাঞ্চল এলাকাতে বাংলাতে সাইনবোর্ড লেখা হচ্ছে না৷ কলকাতা শহরের জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশ এখন অবাঙালি। যারা পুঁজি, চাকরি সবেতেই ভাগ বসাচ্ছে। বাঙালিরা নিজেদের ভাষার প্রতি অসচেতন হওয়ায় বাঙালির অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে রেলস্টেশনে বাংলা লেখা হচ্ছে না, ব্যাঙ্কে বাংলাতে ফর্ম রাখা হচ্ছে না, ব্যাঙ্কের ম্যানেজাররা বাংলাকে ব্রাত্য রেখে হিন্দিতে পরিষেবা দিচ্ছে, রেডিও চ্যানেলে বাংলা গান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, রেডিওর সঞ্চালকরা হিন্দিতে কথা বলছে, বাংলার বুকে কিছু টিভি চ্যানেল হিন্দি ও উর্দুতে খবর পরিবেশন করছে, খবর চ্যানেলের নাম আধা বাংলা-আধা হিন্দিতে লেখা হচ্ছে, বাংলা রিয়্যালিটি শোতে  হিন্দি গান বাজানো হচ্ছে, বাংলা ধারাবাহিকে হিন্দি চলচ্চিত্রের গান বাজানো হচ্ছে, মেট্রো স্টেশনে বাংলাতে ঘোষণা হচ্ছে না, বাংলার বুকে হিন্দি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে, সিনেমাহলে প্রাইম টাইমে বাংলা ছবি চালানো হচ্ছে না, বাংলার সাহিত্যের উন্নতির জন্য ভারত সরকার থেকে কোনো ফান্ডিং করা হচ্ছে না, বাংলা ভাষা প্রসারের জন্য আর্কাইভ খোলা হচ্ছে না, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না, কলকাতা বিমানবন্দরে বাংলা বই বিক্রি করা হচ্ছে না, বাংলার বুকে রমরমিয়ে ব্যবসা ফাঁদছে হিন্দি প্রকাশকরা, শহরে-শহরে হিন্দি-উর্দু সংবাদপত্র বিক্রি করা হচ্ছে, বাংলার ফুটপাথ জোর করে দখল করছে বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত মানুষেরা, প্রশাসনের নাকের ডগায় বাঙালিদের হিন্দি বলতে বাধ্য করছে হিন্দিভাষীরা, বাংলার বহু শহরে হিন্দিভাষীরা বাঙালিদের বাংলা বললে উত্তম-মধ্যম প্রহার করছে। এসব ঘটতে থাকার জন্য স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য যে বাংলা ভাষা আদৌ কী টিকবে?

বাঙালির ওপর শত অত্যাচার হওয়ার পরও মুখ বুঝে সবটা মেনে নেয় অর্ধেক বাঙালি। বাংলা ভাষা নিয়ে কথা বললে তাকে নিয়ে ট্রোল করা হয়, খিল্লি করা হয়। কুড়ি থেকে তিরিশ বছরের বাঙালি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে হিন্দি-ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে খিঁচুড়ি ভাষা বলার প্রবণতা বাড়ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ুন আহমেদ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়দের বই ছেড়ে এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা চেতন ভগৎ পড়ছে। বাংলার নিজস্ব আর্টফিল্ম ছেড়ে বাঙালি যুবক-যুবতীরা উত্তরের ডামাডোল মার্কা আজগুবি ছবি দেখছে। কতগুলো পরিবারের অভিভাবক-অভিভাবিকারা গর্ব করে বলে "আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা"। 

বাংলার অর্ধেক শিল্পী-সাহিত্যিকরা হিন্দি সাম্রাজ্যবাদকে বুঝে উঠতে পারছে না। তাই বইমেলাতে হিন্দি সাহিত্যের অনুষ্ঠান করানো হছে, হিন্দি কবিতা পড়ানো হছে। এতে করে হিন্দি ভাষার প্রসার বাড়ছে। আমরা বাংলা নিয়ে যদি সচেতন না হই, বাংলা ভাষার প্রসারের জন্য যদি আন্দোলন না করি তাহলে খুব তাড়াতাড়ি বাঙালি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে যাবে। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মানে গোলাম হয়ে বেঁচে থাকা৷ বাঙালিরা যে ভুলটার দিকে এগোচ্ছে সেই ভুল পৃথিবীর উন্নত কোনো জাতি করেনি। কাজেই বাঙালিকেও নিজের ভুল শুধরে নিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও ঈশান বাংলার বাঙালি ক্রমশ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। 

প্রতিবেদন- সুমিত দে

No comments